আর্থিক ক্ষতি থেকে বেরোতে পারবে কি অলিম্পিকের স্বাগতিক ফ্রান্স

প্যারিস অলিম্পিক ২০২৪

শুরু হয়েছে ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক। বিংশ শতকের মধ্যভাগের পর বৈশ্বিক ক্রীড়ার সবচেয়ে বড় এই আসরের কলেবর অনেকটা বেড়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ক্রীড়া ইভেন্ট। আয়োজনও হচ্ছে জমকালো। কিন্তু এসবের মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে গত কয়েক আসরজুড়েই উঠছে। সেটা হলো, এই আসর আয়োজন করে আয়োজক দেশের কী লাভ?

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অলিম্পিকের আসর আয়োজন করে আয়োজক দেশের যে লাভ বা সুবিধার কথা বলা হয়, তা মূলত অতিরঞ্জিত। বরং আয়োজক দেশগুলো বড় ধরনের ঋণের চাপে পড়ে এবং বড় বড় অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের ভার চাপে তাদের ঘাড়ে। যদিও ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) বলছে, অলিম্পিক আয়োজনে আয়োজক দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ পর্যটকের আগমনে স্বাগতিক দেশের ব্যবসা বৃদ্ধি পায়।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের এক সংবাদ বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ বিশ্লেষণটির শিরোনাম ছিল—‘দ্য ইকোনমিকস অব হোস্টিং অলিম্পিক গেমস’, অর্থাৎ অলিম্পিক গেমস আয়োজনের অর্থনীতি। সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, একটা দেশ অলিম্পিকের মতো বড় আসর আয়োজন করতে পারবে কি না, তা খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অনেক যাচাই-বাছাই করে। সে জন্য উপদেষ্টাদের সম্মানী, ভ্রমণ, আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতি ইত্যাদি বাবদ অর্থ খরচ করতে হয় আয়োজকদের।

আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতিতেই ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি ডলার খরচ হয়। এই অর্থ খরচ করেও আয়োজক দেশ হওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ২০২০ সালের অলিম্পিকের স্বাগতিক দেশ জাপান ২০১৬ সালেও অলিম্পিক আয়োজন করতে চেয়েছিল। ওই বছর স্বাগতিক দেশ হতে জাপান ১৫ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে জাপানকে খালি হাতেই ফিরতে হয়। পরে আরও সাড়ে সাত কোটি ডলার খরচ করে ২০২০ সালে তারা স্বাগতিক দেশ হতে পেরেছে।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস বলছে, বিংশ শতকের শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত অলিম্পিক আয়োজন করা স্বাগতিক দেশগুলোর জন্য অতটা কঠিন ছিল না। বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশ বা অন্য ধনী দেশগুলোতে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। টেলিভিশনে সরাসরি খেলা সম্প্রচারের যুগ শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত স্বাগতিক দেশগুলো এই আয়োজন থেকে খুব একটা মুনাফা করার কথাও ভাবত না।

অলিম্পিক গেমসের অর্থনীতি নিয়ে বই লিখেছেন অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু জিম্বালিস্ট। একটি নয়, তিনি মোট তিনটি বই লিখেছেন এ বিষয়ে। অ্যান্ড্রু জিম্বালিস্টের মতে, ১৯৭০-এর অলিম্পিক আয়োজনটি অলিম্পিকের মোড়ঘোরানো আয়োজন। তখন থেকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। আর এই আয়োজনের আর্থিক ঝুঁকির বিষয়টি প্রথম জনসমক্ষে আসে ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে। ধারণা করা হয়েছিল, সেবার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে ১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের বেশি। সেই প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গিয়ে কানাডা ১৫০ কোটি ডলার ঋণ করে এবং তা পরিশোধ করতে প্রায় ৩ দশক সময় লেগে যায়।

এদিকে ২০২৪ সালের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে উঠে এসেছে, ১৯৬০ সালের পর অলিম্পিক আয়োজনের গড়পড়তা খরচ নিলাম মূল্যের অন্তত তিন গুণ। এবারের প্যারিস অলিম্পিকে ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৮৭০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। তবে আশা করা হচ্ছে, এত দিন স্বাগতিক দেশগুলো যেভাবে অলিম্পিক আয়োজন করে ঋণের বোঝায় চাপা পড়েছে, এবার তা আর হবে না। তারপরও অবকাঠামো বাবদ প্যারিস এবার ৪৫০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তা হয়েছে মূলত অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণে। বার্ষিক ফরাসি ওপেন ও ২০১৬ সালের ইউরো ফুটবলের সময় তারা যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল, সেগুলোই এবার ব্যবহৃত হবে। এ কারণে তাদের অবকাঠামোর খরচ আগের অলিম্পিকের চেয়ে কম।

১৯৮৮ সাল থেকে আয়োজিত সব শীত ও গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়েছে। ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রাক্কলনের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ২৬৬ শতাংশ; ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১৫১ শতাংশ; ২০০০ সালের সিডনি গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৯০ শতাংশ। বিনিয়োগ ধরে বিবেচনা করলে অবশ্য অলিম্পিকের আয়োজন থেকে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি চোখে পড়ে। যেমন ২০১২ সালের লন্ডনের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আয় হয়েছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার, অথচ খরচ ছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে ভ্যাঙ্কুভার শীতকালীন অলিম্পিকে ৭৬০ কোটি ডলার খরচ করে দেশটি তুলতে পেরেছিল ২৮০ কোটি ডলার। অলিম্পিক আয়োজনে একমাত্র লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্ষতি কম হয়েছিল। কারণ, শহরটিতে কয়েকবার অলিম্পিক আয়োজন হওয়ায় তাদের অবকাঠামো তৈরিতে খরচ হয়েছিল কম।

অলিম্পিক আয়োজনের খরচ আকাশ ছুঁইয়েছে, যদিও এই আয়োজন থেকে অর্থনৈতিক লাভ কী হয়, তা স্পষ্ট নয়। এবার অলিম্পিক আয়োজনের নিয়মকানুনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ফলে এবারের অলিম্পিক স্বাগতিকদের জন্য লাভজনক হয় কি না, তা দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে আছেন।