লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের পর এশিয়ার প্রযুক্তিপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে গত মঙ্গলবার হাজার হাজার পেজারের (তারহীন যোগাযোগের যন্ত্র) বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরদিন দেশটিতে ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ, রেডিও ডিভাইস প্রভৃতি যন্ত্রেও বিস্ফোরণ ঘটে। এসব বিস্ফোরণের পরে পেজারসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সরবরাহের অন্ধকার দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যের উৎস থেকেই মূলত ডিভাইসগুলো লেবাননে পাঠানো হয়েছিল, যেগুলো বিস্ফোরণের কাজে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে এখানে তাইওয়ান ও জাপানের নাম আলোচনায় বেশি আসছে।
প্রযুক্তি খাতের বিশ্লেষক ও পরামর্শকেরা জানান, পেজারের মতো পুরোনো প্রযুক্তিপণ্যগুলোর বাজার নিয়ে তেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই। ফলে এসব উৎস থেকে ক্রেতারা নিরাপদ পণ্য কিনছেন কি না, সে সম্পর্কেও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, সাধারণত উচ্চ মূল্যের ও নতুন প্রযুক্তিপণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনগুলো বেশ সাবধানতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে এশিয়ার পুরোনো ইলেকট্রনিক পণ্যগুলো ব্যতিক্রম। নকল পণ্য, অতিরিক্ত মজুত ও জটিল উৎপাদন চুক্তির (ক্রেতার চাহিদা অনুসারে তৈরি) কারণে প্রায়ই এই পণ্যগুলো ঠিক কোথা থেকে এসেছে, তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।
বিস্ফোরণে লেবাননে এ পর্যন্ত ৩৭ জন নিহত ও ৩ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। পেজারসহ ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলোয় আগে থেকেই স্বল্প পরিমাণে হলেও শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে মারাত্মক এ বিস্ফোরণের পরে পণ্যগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠছে। এসবের উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, নরওয়ে ও রোমানিয়া।
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ প্রায় পাঁচ মাস আগে এসব যন্ত্র হাতে পেয়েছিল বলে জানিয়েছে রয়টার্স। তারা মনে করেছিল, প্রকৃত উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকেই এসব পণ্য কেনা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো এখন দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রথমেই পেজারের কথা বলা যাক। পেজারগুলোর গায়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলোর নাম ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, পেজার হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব পেজার তৈরি করেছে বিএসি কনসালটিং নামের হাঙ্গেরির একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে গোল্ড অ্যাপোলোর ট্রেডমার্ক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
পেজারের পাশাপাশি লেবাননে ওয়াকিটকি বিস্ফোরণও হয়; যেখানে জাপানের প্রতিষ্ঠান আইকমের নাম উঠে আসে। অভিযোগ ওঠার পরে আইকম প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, লেবাননে তাদের নামে পাওয়া ওয়াকিটকিগুলো আসল কি না, তা বলতে পারছে না তারা। কারণ, বাজারে নকল পণ্যে ভরা। ফলে বিস্ফোরিত পণ্যগুলো তাদের তৈরি ছিল, এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আইকম লেবাননের টেলিকমমন্ত্রী জনি কর্মের বরাত দিয়ে বলেছে, ডিভাইসগুলো কোনো পরিবেশকের মাধ্যমে আমদানি (লেবাননে) করা হয়নি। বরং একই মডেল নম্বরের নকল পণ্য অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। আর তাইওয়ানের অর্থমন্ত্রী কুও জেহ-হুইও বলেছেন, লেবাননে বিস্ফোরিত পেজারে ব্যবহৃত উপাদানগুলো তাঁর দেশে তৈরি হয়নি।
নকল পণ্যের ছড়াছড়ি
আপাতত এটা কেউই নিশ্চিত নয় যে কখন ও কীভাবে পেজার ও ওয়াকিটকিগুলোয় বিস্ফোরক বসানো হয়েছিল, যার মাধ্যমে দূর থেকে সেগুলোর বিস্ফোরণ করা যায়। জাতিসংঘের কাছে দেওয়া লেবাননের কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক এক তদন্তে দেখা গেছে, যন্ত্রগুলো দেশে আসার আগেই তাতে বিস্ফোরক স্থাপন করা হয়েছিল।
চীনভিত্তিক প্রযুক্তিবিদ ডেভিড ফিঞ্চার বলেছেন, কেউ যদি সাপ্লাই চেইনের কোনো পর্যায়ে পণ্যগুলোর ভেতরে বিস্ফোরক রাখতে সক্ষম হয়, তবে তা হবে অবিশ্বাস্য ধরনের প্রকৌশলগত কর্মকাণ্ড। তবে এটাও ঠিক যে সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে এ ধরনের আপস করা খুব কঠিন কিছু নয়।
তবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বলে আসছে, তাদের তৈরি নয়, বরং বিস্ফোরণে নকল পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তিবিদ ডেভিড ফিঞ্চার জানান, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নকল পণ্য তৈরি ও সরবরাহের প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে চীনের মতো বড় উৎপাদন কেন্দ্রে সহজেই নকল উপকরণ তৈরি করা যায়। তিনি বলেন, ‘একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে আমি বলতে পারি, একটি রেডিওতে সামান্য বিস্ফোরক পাওয়া এতটা কঠিন কিছু নয়।’
২০২০ সালের এক জরিপে জাপানের সাত শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠান জানায়, তারা নকল পণ্যের কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছে। জাপান পেটেন্ট অফিসের তথ্য অনুসারে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে নকল পণ্য তৈরি হয় চীনে।
এদিকে নকল পণ্য বলে সম্পূর্ণ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন অনেকে। তবে এ ক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার অভাব রয়েছে। চীনের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ইস্ট আইপির অংশীদার জো সিমোন বলেন, সরবরাহ চেইনে সমস্যার একটি দিক হচ্ছে ছোট ব্র্যান্ডের সক্ষমতার অভাব। ছোট ব্র্যান্ডগুলো নকল পণ্য তদারকির পেছনে কম বিনিয়োগ করে। কারণ, এই ব্যয় তাদের লাভের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
জাপানের প্রতিষ্ঠান আইকম প্রকৃত পণ্য কেনার জন্য শুধু তাদের অফিশিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে গ্রাহকদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছে। তবে চীনে আলিবাবা ডটকম, তাওবাও এবং জেডি ডটকমের মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে আইকম ব্র্যান্ডের ওয়াকিটকি বিক্রির কয়েক ডজন সরবরাহকারী রয়েছে। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে গ্রাহকেরা যে পণ্য কিনছেন, তা নিরাপদ কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।