ধনীরা কেন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, অপরাধের সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক সহজ-সরল নয়, বরং বিষয়টি জটিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রভাব আপেক্ষিক।
বিশ্বজুড়ে হোয়াইট কলার ক্রাইম বা সচ্ছল মানুষের অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ রোধে ভিয়েতনামে ‘ব্লেজিং ফারনেস’ শীর্ষক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে দেশটির কোমল পানীয়ের বাজারের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ট্রান কুই থানহ ৪ কোটি ডলারের এক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আট বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
সেই মামলায় তাঁর কন্যাকেও দণ্ডিত করা হয়। এর কয়েক সপ্তাহ আগে ভিয়েতনামের আরেক শতকোটিপতি ও আবাসন খাতের বড় ব্যবসায়ী ট্রুয়ং মাই ল্যানকে সাড়ে ৪ কোটি ডলারের জালিয়াতির মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁর মূল অপরাধ, দেশটির অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক লুণ্ঠন করা।
এদিকে গ্রহের আরেক প্রান্তে বা যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিপ্টো জালিয়াতির অভিযোগে ক্রিপ্টো কারেন্সি এক্সচেঞ্জ এফটিএক্সের মালিক স্যাম ব্যাংকম্যানের ২৫ বছরের সাজা হয়। ২০২২ সালে আরেক বড় উদ্যোক্তা জালিয়াতির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে দণ্ডিত হন। জৈব প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা এলিজাবেথ হোমস ভিন্ন এক জালিয়াতির মামলায় ১১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
এসব ঘটনায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ধনীরা কেন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন? দরিদ্রদের মতো তাঁদের তো খেয়েপরে বেঁচে থাকার সমস্যা নেই। বাস্তবতা হলো, বিশ্বের অনেক ধনী মানুষের এত অর্থ আছে যে তাঁদের পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম শুয়েবসে খেতে পারবে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, অপরাধের সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক সহজ-সরল নয়, বরং বিষয়টি জটিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রভাব আপেক্ষিক, যেমন ধনী ব্যক্তিদের ছোট অঙ্কের আর্থিক জরিমানা করা হলে তার প্রভাব এদের জীবনে পড়ে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারও সাপ্তাহিক আয় ৫০০ মার্কিন ডলার হলে ৩০০ ডলার জরিমানা দেওয়া তার জন্য কঠিন। কিন্তু কারও আয় ১০ হাজার ডলার হলে তাকে ৩০০ ডলার জরিমানা করা হলে সেটি গায়েই লাগবে না। সে কারণে ফিনল্যান্ডের মতো দেশে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জরিমানা আয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদিও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে শেষমেশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল পর্যন্ত হতে পারে। এতে ধনী ও গরিব উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কোম্পানির কর্মপরিবেশ ও প্রণোদনা কাঠামোর কারণেও অনেক কর্মী দুর্নীতি করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। মানুষ জন্মগতভাবে সমাজবিরোধী নয়; কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে ও রকম করতে বাধ্য বা প্রলুব্ধ হয়।
যেসব অপরাধের সাজা হিসেবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, সেসব অপরাধ করে জেলে যাওয়া ধনীদের জন্য বেশি কষ্টকর। ধনীদের দামি বাড়ি-গাড়ি থাকে, সেই সঙ্গে থাকে জীবনকে উপভোগ করার মতো সব আয়োজন। ফলে সেই আয়েশি জীবন ছেড়ে জেলে যাওয়া তাঁদের জন্য বেশি কষ্টকর।
ধনীদের অপরাধ আবার ঠিক রাস্তার অপরাধের মতো নয়। ডাকাতেরা বড় কোনো দোকান লুট করলে তার প্রভাব সরাসরি সেই দোকানমালিকের ওপর পড়ে; কিন্তু বড় কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লুণ্ঠন করলে তার প্রভাব একক ব্যক্তির ওপর পড়ে না। এমনকি অপরাধীদের সহানুভূতির অভাব থাকলে তাঁদের মনে হতে পারে, ব্যাংক লুট করা অপরাধই নয়।
এমনকি যাদের কিছুটা বিবেক বা আত্ম-অনুশোচনা আছে তাঁরাও দেখেন, পরিস্থিতি দুর্নীতির জন্য খুবই অনুকূল। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে অনেকের পক্ষে এই প্রলোভন ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়, বা অনেকে বন্ধু স্থানীয়দের চাপে এই পথে পা বাড়ান।
বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য দ্য ফ্রড ট্রায়াঙ্গেল নামের এক মডেল প্রণয়ন করেছেন কর্মক্ষেত্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টিভ আলব্রেখট। এই মডেলের ত্রিভুজের তিনটি বাহুতে যে বিষয়গুলোর অবস্থান সেগুলো হলো, অনুমিত চাপ, অনুমিত সুযোগ ও জালিয়াতির যৌক্তিকীকরণ। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, এই তিনটি উপাদান একত্র হলে মানুষ অপরাধ করার অনুপ্রেরণা পায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষ যে পেশায় কাজ করছে, সেই পেশার গতিপ্রকৃতির কারণেও তারা অপরাধ করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি এনরনের পতনের পর কিছু কর্মীর দাবি ছিল, তাঁরা যে অন্যায় করেছিলেন, সেই অন্যায় করতে কোম্পানিই তাদের প্রলুব্ধ করেছিল। ২০১৬ সালে ওয়েলস ফারাগো কেলেঙ্কারির সময়ও দেখা গেছে, কর্মীরা বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ভুয়া হিসাব খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ ঘটনায় ওয়েলস ফারাগোর ১৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার জরিমানা হয়েছিল।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক পিটার ভ্যান ভিন বলেন, কর্মীদের প্রণোদনা দেওয়ার কাঠামো ঠিকঠাকভাবে তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ; তা না হলে কোম্পানির ওপর বড় ধরনের অভিঘাত পড়তে পারে।
কোম্পানির কর্মপরিবেশ ও প্রণোদনা কাঠামোর কারণেও অনেক কর্মী দুর্নীতি করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। মানুষ জন্মগতভাবে সমাজবিরোধী নয়; কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে ও রকম করতে বাধ্য বা প্রলুব্ধ হয়। তবে এমন পরিস্থিতিও দেখা যায়, যখন এসব শর্তের অনুপস্থিতিতে ধনী মানুষেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কখনো দেখা যায়, ধনী মানুষেরা দোকান থেকে চুরি করেন, যদিও এই চুরি থেকে তাঁর প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম, বরং হারানোর সম্ভাবনা বেশি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধনীদের মধ্যে দোকান থেকে চুরির প্রবণতা বেশি। যদিও তাঁর সঙ্গে আর্থিক অবস্থার ঠিক মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এর পেছনে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে, যেগুলো ঠিক পরিষ্কার নয়।
বিশ্লেষকদের মধ্যে একদল মনে করেন, আর্থিক কারণে নয়, দোকান থেকে চুরি করায় যে উত্তেজনা আছে, তার কারণে অনেক ধনী মানুষ তা করে থাকেন। এর সঙ্গে মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে; অর্থাৎ উদ্যোক্তা হতে মানুষ যে ঝুঁকি নেন, সেটা তাঁদের মনে এই আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় যে দোকান থেকে ১০ ডলারের লিপস্টিক চুরি করে সে পার পেয়ে যাবে।
শেষ কথা হলো, দোকান থেকে ১০ ডলারের লিপস্টিক চুরি করা বা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লোপাট করে দেওয়া, এই প্রবণতার আরেকটি কারণ হতে পারে এই যে তাঁরা জানেন, তাঁদের যে সম্পদ আছে, তা দিয়ে ভালো উকিল ধরা যাবে। পয়সা দিলে এই উকিলেরা শাস্তির মাত্রা হ্রাস করে দিতে পারে।