২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ট্রাম্প জিতলে বিশ্ব বাণিজ্যের কী হবে, বাংলাদেশের বাণিজ্যে কী ঘটতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

বলা যায়, পুরো বিশ্বই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। সব জরিপ বলছে, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। যেসব রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে, সেসব রাজ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের মধ্যে ব্যবধান খুবই কম। তবে বিশ্লেষকেরা উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জয়ী হলে বিশ্ব অর্থনীতির কী হবে।

নিজের প্রথম মেয়াদেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তথাকথিত বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তখন তাঁর মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল চীন। কিন্তু এবারে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি লড়াইয়ের ময়দান আরও বিস্তৃত করবেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করার ওপর যেসব দেশ বেশি নির্ভর করে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছেই। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে কেবল চীন নয়, বরং বিশ্বের সব দেশই তাঁর কঠোর বাণিজ্যনীতির আঁচ টের পাবে।

আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অস্ত্রটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবেন তা হলো, ট্যারিফ বা শুল্ক। তিনি বারবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য আমদানি করে, তার ওপর ১০ শতাংশ অথবা ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা করছেন তিনি। আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক হবে ৬০ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি এমনকি ১০০ শতাংশও হতে পারে।

গত মাসে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প শিকাগোতে ইকোনমিক ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার কাছে ডিকশনারির সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হলো ট্যারিফ (শুল্ক)। এটি আমার খুব পছন্দের শব্দ।’

ট্রাম্পের এই বাণিজ্যনীতির উদ্দেশ্য হলো, আমেরিকার উৎপাদনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা। এবারের নির্বাচনে তিনি আবারও সেই পুরোনো স্লোগান নিয়ে এসেছেন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন; অর্থাৎ আমেরিকাকে আবার মহান গড়ে তুলুন।’ এর পাশাপাশি তাঁর নতুন স্লোগান ছিল, ‘ড্রিম বিগ এগেইন’। সমর্থকদের তিনি আবারও বড় করে স্বপ্ন দেখতে বলেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব নীতির একটি লক্ষ্য, আমেরিকার ব্যবসা–বাণিজ্য আর অর্থনীতিকে সংরক্ষণবাদের মাধ্যমে একধরনের নিরাপত্তা দেওয়া। নির্বাচনী প্রচারে তিনি শুল্ককে বর্ণনা করেছেন এমন একটি হাতিয়ার হিসেবে, যা একসঙ্গে অনেকগুলো উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে। তাঁর মতে, যারা বাণিজ্যে অন্যায্য কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের শাস্তি দিতে পারে, বিদেশে কার্যক্রম স্থানান্তর করা থেকে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং ফেডারেল সরকারের ঘাটতি কমাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে পারে।

কিন্তু অনেক অর্থনৈতিক নীতির মতো ট্রাম্পের এই নীতিরও নেতিবাচক দিক রয়েছে। আর সে কারণে তাঁর নীতি নিয়ে উদ্বেগ আছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। ট্যারিফ বা শুল্ক বাড়ালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মার্কিন ব্যবসা–বাণিজ্য। আরও বেশি চাপে পড়তে পারেন মার্কিন ভোক্তারা। শুল্ক যে পণ্যের মূল্য বাড়ায়, এটি মানতে চান না রিপাবলিকান প্রার্থী। তিনি সব সময় এই যুক্তি এড়িয়ে যান।

ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতিকে বর্ণনা করেছেন ‘ট্রাম্প ট্যাক্স’ হিসেবে। বেশ কয়েকটি স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের খরচ বাড়াবে। বছরে এমন একটি পরিবারের খরচ ১ হাজার ৩৫০ ডলার থেকে শুরু করে ৩ হাজার ৯০০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে; অর্থাৎ নতুন শুল্ক ভোক্তার জন্য নেতিবাচক হবে।

ভুগবেন মার্কিন ক্রেতারা

মাত্রই প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মার্কিন ক্রেতারা বছরে ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের ক্রয় সক্ষমতা হারাতে পারেন। ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের (এনআরএফ) ওই জরিপে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ওই শুল্ক পোশাক, খেলনা, আসবাব, গৃহস্থালিপণ্য, জুতা এবং ভ্রমণ–সংক্রান্ত পণ্যের বিক্রিকে প্রভাবিত করবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ দেরি না করে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে প্রচলিত সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র কাজে লাগায়। নীতি সুদহার এতটাই বাড়ানো হয় যে তা অনেক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। ফলে ঋণ করার খরচ এমন এক দেশে বাড়ে, যেখানে মানুষের ঋণ করে নিত্যদিনের খরচ চালোনা খুব সাধারণ বিষয়।

একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে ঋণ করার খরচ বৃদ্ধি—ফলে  প্রায় দুই বছর ধরে আমেরিকানরা অনেক মিতব্যয়ী। সে কারণে প্রয়োজন কম, এমন জিনিস কেনার ক্ষেত্রে তাঁরা এখন খুবই সাবধানী। খরচ কমানোর কারণে দেশটিতে খুচরা বিক্রি কমেছে, ফলে ভোক্তাপণ্য কোম্পানিগুলোও অসুবিধায় পড়েছে।

সোমবার গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে এনআরএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোনাথন গোল্ড বলেন, মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা মূলত নির্ভর করেন আমদানি করা পণ্যে ওপর। তাঁরা বিদেশ থেকে পণ্য ও উৎপাদন সহায়ক কাঁচামাল আনেন। এরপর সেই পণ্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেন সহনীয় মূল্যে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক বছর ধরে দাবি করছেন, বিদেশি যেসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠায়, তারাই শুল্ক পরিশোধ করে। তবে বাস্তবে আমদানিকারক মার্কিন কোম্পানিই শুল্কের অর্থ পরিশোধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের গবেষণা দেখাচ্ছে, চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের জমানায় যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই মার্কিনিদের বহন করতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের বাণিজ্যের লাভ না ক্ষতি

বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর মোটামুটি ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই রপ্তানির বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে চীন আর ভিয়েতনাম।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি যদি তাঁর ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, তবে তা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। তবে তিনি যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ না করেন, তাহলেই কেবল সুবিধা হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে। সুতরাং ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে তা বাংলাদেশের রপ্তানিকে প্রভাবিত করবে না। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ট্রাম্প যদি শাস্তিমূলক কোনো শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে তা দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁর মনোভাবের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন।

চীনের ওপর প্রস্তাবিত ট্যারিফের প্রসঙ্গে এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য–বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন বিশ্বের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক দেশ। ট্রাম্প যদি তাঁর কথামতো চীনের ওপর বড় হারে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে তা বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বাজার ধরতে পারবে এসব দেশ। কারণ, এসব দেশকে তুলনামূলক কম শুল্ক দিতে হবে।

অন্যদিকে, ট্রাম্প যদি তাঁর বিশেষ কোনো বন্ধুরাষ্ট্রকে আবার শুল্ক সুবিধা দেন, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি যেকোনো দিকেই যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটার দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।’