ছাড়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন মার্কিন ক্রেতারা

ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দোকান ছাড় দিয়েছে।রয়টার্স

চুল থেকে তুষার কণা ঝেড়ে ফেলে টেগান হিকসন ইন্ডিয়ানার ফোর্ট ওয়েইনে ওয়ালমার্টের একটি সুপারশপে ঢুকলেন। ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে ছাড়ে কিছু পাওয়া যায় কি না, সেই আশায় সেখানে যান দুই সন্তানের এই জননী।

দোকানে ঢুকেই তাঁর চোখে পড়ে ডিজিটাল এয়ার ফ্রায়ারের দিকে, দাম ৫০ ডলার। তিনি ভাবলেন, তাঁর বোন জর্ডানের জন্য এটি দারুণ উপহার হতে পারে, জর্ডানও অনেক দিন ধরে এয়ার ফ্রায়ার কেনার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাঁর চিন্তা হলো, পরিবারের সবাই এখন বেশ টানাটানির মধ্যে আছেন। খবর রয়টার্স।

ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও চিন্তা হচ্ছে তাঁর। ফেসবুকে কিছু পোস্ট দেখে তিনি জানতে পেরেছেন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারি মাসে প্রতিশ্রুত শুল্ক বৃদ্ধি করলে অনেক পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

৪৩ বছর বয়সী টেগান হিকসন রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি খুব বেশি খরচ করতে চাই না; আমার ক্রেডিট কার্ডের দেনা বাড়াতে চাই না। কিন্তু পরের বছর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাক, সেটাও আমি চাই না।’

থ্যাংকসগিভিং হলিডের পর ব্ল্যাক ফ্রাইডে উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের দোকানগুলো পুনরায় খুললে ক্রেতাদের ভিড় জমে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীতকালীন কেনাকাটা শুরু হয়। সে জন্য ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে দোকানগুলো কী ছাড় দিল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোই–বা কী ছাড় দিচ্ছে, তা তুলনা করতে মানুষ ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকে দোকানে ভিড় করেন।

আমেরিকান মানুষের মনে এখন নতুন উদ্বেগ; ২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমদানি পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপ করলে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই শুল্কের প্রভাবে টেগান হিকসনের মতো ভোক্তাদের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।

ব্ল্যাক ফ্রাইডের ছাড় এই মুহূর্তে কিছুটা স্বস্তি দিলেও ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির শঙ্কা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতারা এখন থেকেই সাশ্রয়ী কেনাকাটার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করছেন।

ওয়ালমার্টে থাকা অবস্থায় টেগান হিকসন স্বামী জশকে ফোন করেন। জশ তখন বাড়িতে কম্পিউটারের সামনে বসে অনলাইনে পণ্যের দামের সঙ্গে ওয়ালমার্টের দোকানের দাম তুলনা করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, দোকানের পণ্যের দামের সঙ্গে অনলাইনের দামের পার্থক্য বের করা, যেন সবচেয়ে কম দামে পণ্য কেনা যায়।

জশ অনলাইনে একটি পণ্যের দামের খোঁজখবর নিয়ে বের করলেন, ওয়ালমার্টে তার দাম অর্ধেক। এই খবর পেয়ে টেগান দ্বিধা না করে দ্রুত একটি বাক্স তুলে ট্রলিতে রাখলেন এবং স্টোরের ভেতরে আরও ভালো জিনিস খুঁজতে শুরু করলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ৪ হাজার ৭০০টি দোকান আছে ওয়ালমার্টের। ব্ল্যাক ফ্রাইডে উপলক্ষে স্যামসাং টিভি, ডাইসন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, লেগো, হট হুইলস খেলনা, লিভাইস জিনস ও এয়ার ফ্রায়ারে বিশেষ ছাড় দিয়েছে তারা।

নিউ জার্সির নর্থ বার্গেন এলাকায় ওয়ালমার্টের আরেকটি দোকানে কেনাকাটা করছিলেন ক্রিস্টাল লোপেজ, তাঁর ট্রলিও বেশ ভরে গেছে। তিনি বলেন, দামের ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না, গত বছরের মতোই মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। ক্রিস্টাল জানান, এই ছুটিতে কেনাকাটার জন্য এক হাজার থেকে থেকে দুই হাজার ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা আছে তাঁর। গত বছরও তিনি এমন বাজেট করেছিলেন। মূলত পোশাক কেনাতেই তিনি ব্যস্ত।

বিষয়টি হলো, ক্রিস্টালের মতো কিছু ক্রেতা এখনো ছুটির সময়ের কেনাকাটার বাজেট অপরিবর্তিত রাখতে পেরেছেন, যদিও অর্থনৈতিক চাপ ও ভবিষ্যতের ব্যয় নিয়ে অনেকের মনে উদ্বেগ রয়ে গেছে। তারপরও ছুটির মৌসুমে বিশেষ ছাড় ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণীয়।

অ্যাডোবি অ্যানালিটিকস অনুযায়ী, আমেরিকানরা এখন মুঠোফোন ও ল্যাপটপ ব্যবহার করে বেশি কেনাকাটা করছেন। ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে তাঁরা অনলাইনে ৭৯০ কোটি ডলার ব্যয় করেছেন; গত বছরের তুলনায় যা ৮ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। অ্যাডোবি অ্যানালিটিকস অ্যাডোবি সফটওয়্যার ব্যবহার করে মার্কিন নাগরিকদের অনলাইনে কেনাকাটার সহজীকরণ করে থাকে।

যাঁরা পুরোনো মডেলের টিভি হালনাগাদ করতে চেয়েছেন, তাঁরা সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পেয়েছেন। গড়ে খুচরা বিক্রেতারা বিশ্বজুড়ে ক্রেতাদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে, যা গত বছরের ২৬ শতাংশ ছাড়ের তুলনায় কিছুটা কম। এই তথ্য সেলসফোর্সের, এটি ক্লাউডভিত্তিক সফটওয়্যার কোম্পানি, ই-কমার্স ক্রেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাণিজ্য সংস্থা ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন আশা করছে, এ বছর প্রায় ৮৫.৬ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ৫৬ লাখ ক্রেতা দোকানে গেছেন, গত বছর যা ছিল ৭৬ মিলিয়ন বা ৭ কোটি ৬০ লাখ। এবার ক্রেতাদের কাছে থ্যাংকসগিভিং থেকে ক্রিসমাস বা বড় দিন পর্যন্ত সময় আছে মাত্র ২৬ দিন; গত বছর যা ছিল ৩১ দিন।

খুচরা বিক্রেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতাদের অতিরিক্ত খরচের প্রতি অনীহা; তাঁরা শুধু ভালো ছাড় পেলে কেনাকাটা করতে ইচ্ছুক।

কম সময়ের মধ্যে কেনাকাটা করতে গিয়ে ক্রেতারা আরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেনাকাটা করতে পারেন। এর ফলে ছুটির মৌসুমে খুচরা বিক্রয়ে গতি আসবে বলে মনে করেন সারকানা নামক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান খুচরা বিক্রয় উপদেষ্টা মার্শাল কোহেন।

তবে মূল সমস্যা মূল্যস্ফীতি। গত আড়াই বছরে অনেকটাই মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যদিও সম্প্রতি তা অনেকটা কমেছে। অবশ্য কমলেও তার জের এখনো আছে। ৫৮ বছর বয়সী শেফ হস মস বলেন, ব্ল্যাক ফ্রাইডে এখন আর আগের মতো নয়। গত ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম তিনি টার্গেটের বিপণিবিতানের সামনে দাঁড়িয়েছেন কিশোরী মেয়ের জন্য বই কিনতে।

হস মস আরও বলেন, ‘খাবারের দাম অনেক বেশি এবং...এমনকি পোশাকের দামও আগের তুলনায় বেশি। চারজনের পরিবার নিয়ে এবার উপহার বাবদ দুই থেকে তিন হাজার ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করেছেন বলে তিনি জানান।