২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সম্ভাবনাময় যে রপ্তানি বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ

বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫% শুল্ক দিতে হয়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে ভারত এফটিএ করলেও বাংলাদেশের কোনো অগ্রগতি নেই।

অনেক সম্ভাবনাময় বাজার হওয়া সত্ত্বেও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য সেভাবে যাচ্ছে না। এসব দেশের মধ্যে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিলও রয়েছে। ব্রাজিলে পণ্য রপ্তানির তুলনায় দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৯ গুণ বেশি।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে—এই চার দেশ হচ্ছে লাতিন আমেরিকার ‘মারকোসার’ নামের বাণিজ্য জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটটির সহযোগী সদস্য হচ্ছে বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, পেরু ও সুরিনাম। বাংলাদেশ প্রায় ছয় বছর ধরে মারকোসার জোটের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তিন বছর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দেশগুলো ঘুরে আসে। এরপর আর কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে এবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনকে নিয়ে ব্রাজিলে রয়েছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অন্য সব দেশ ঠিকই ভালো বাণিজ্য করছে। আরও বাণিজ্য করার জন্য তারা মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও (এফটিএ) করেছে। পিছিয়ে শুধু বাংলাদেশ। মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ভারত, মিসর, ইসরায়েল, মেক্সিকো, মরক্কো ও দক্ষিণ আফ্রিকা কাস্টমস ইউনিয়নের (এসএসিইউ) সঙ্গে এফটিএ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যদেশগুলোর সঙ্গেও এখন মারকোসারের এফটিএ চূড়ান্ত হওয়ার পথে। সিঙ্গাপুর, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও কানাডার সঙ্গে মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর এফটিএর আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি চলছে। এ ছাড়া চীনও মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক হারে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এক প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের জনসংখ্যা ৩০ কোটি, গড় মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের বেশি এবং মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) চার ট্রিলিয়ন বা চার লাখ কোটি মার্কিন ডলার। তাই এফটিএ করা গেলে উভয় পক্ষেরই বাণিজ্য বাড়বে, তবে এতে বেশি লাভবান হবে বাংলাদেশ।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে—এই চার লাতিন দেশও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভালোই পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে কম। মারকোসারের সঙ্গে এফটিএ করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেন ব্রাজিলে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সক্রিয় হয় এবং বৈঠক করে। বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, মারকোসার একটি বিশাল বাণিজ্য অঞ্চল, যেখানে বাংলাদেশি পণ্যের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনার তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। কারণ, দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য ঢুকতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে। এফটিএ করে শুল্ক কমানো বা শূন্য করা গেলে দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার বড় হবে।

চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ২০১৯ সালের আগস্টে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে সফর করে। এরপর দেশ চারটির অর্থ, পররাষ্ট্র, শিল্প ও বাণিজ্য, শ্রম ও উৎপাদন এবং কৃষিমন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠান টিপু মুনশি।

মারকোসারভুক্ত দেশগুলোতে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে ব্রাজিলের বাণিজ্যিক রাজধানী সাওপাওলোতে একটি কনসাল জেনারেল অফিস স্থাপনের অনুরোধ জানালে বাণিজ্যমন্ত্রী একই বছরের অক্টোবরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। এরপর ব্রাজিলে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এফটিএ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। পাশাপাশি ব্রাজিলে অবস্থিত আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের কূটনৈতিক মিশনেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এদিকে উরুগুয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অফিশিয়াল পাসপোর্টে ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা পদ্ধতি চালুর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশটির সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি করতে আলাদা চিঠি পাঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে।

এ ছাড়া মারকোসারভুক্ত দেশগুলো ভ্রমণে উৎসাহিত করতে এফবিসিসিআইসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এভাবে দেশ-বিদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাঠানো ছাড়া আর কোনো অগ্রগতিই হয়নি। বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তেমন গুরুত্ব দেয় না।

বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘মারকোসারভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। অন্যপক্ষে যারা আছে, তারা একটু রক্ষণশীল। তা ছাড়া দূরত্ব একটা বড় কারণ। যদিও ওই দূরত্ব মেনেই আমরা আমদানি করছি, বিশেষ করে ব্রাজিল থেকে।’ তিনি বলেন, সরকারের দিক থেকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দিয়ে উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সহযোগিতা দেওয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে তাদেরই বেশি অগ্রগামী থাকতে হবে।

বাংলাদেশ কী চায়, কী করছে

বাণিজ্যমন্ত্রীর সফরের এক বছর পর ২০২০ সালের অক্টোবরে ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসা মারকোসারভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠান। এরপর ২০২১ সালের ১৬ মার্চ বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ওই প্রতিবেদন ও বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর এফটিএ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া আর্জেন্টিনায় ২০২১ সালে সমাজতান্ত্রিক ধারার সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যারা আদর্শগতভাবে এফটিএ করতে আগ্রহী নয়। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশগুলোর অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। তারা এফটিএ করার আগে কোভিডের ক্ষতি পোষানোর কাজে বেশি মনোযোগ দেবে। তাই দেশগুলোর সঙ্গে এফটিএ করতে হলে লম্বা সময়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোনোর মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী চিঠি দেওয়ার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ব্রাজিল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর উপলব্ধি হলো, তারা এ ব্যাপারে নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে ইতিবাচক জবাব দেবে। তাই রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ হচ্ছে, ব্রাজিলে যেসব বাণিজ্য মেলা হয়, সেগুলোতে যেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) অংশ নেয়। আর ভারত ও চীনের মতো বাংলাদেশ যেন ওষুধপণ্য রপ্তানির বিষয়ে বেশি মনোযোগী হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাজিল বছরে ১৮ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ দেশটিতে রপ্তানি করে দশমিক ১ শতাংশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষ দেশ চীন ব্রাজিলে রপ্তানি করে ৫৮ শতাংশ, অথচ দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ রপ্তানি করে ১১ শতাংশ। ব্রাজিলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে এখনকার চেয়ে অন্তত তিন গুণে উন্নীত করতে চায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারকোসারভুক্ত দেশগুলোর বাজার বড় সন্দেহ নেই। বাংলাদেশি পণ্য যাওয়ার সুযোগও আছে। কিন্তু বাজারটি ভালো করে অনুসন্ধান করিনি আমরা ব্যবসায়ীরাই। সরকারের কিছু নীতিগত সমর্থনের দরকার আছে, তবে মূল দোষ আমাদেরই।’ এ ব্যাপারে বহুপক্ষীয় বৈঠক করে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার বলে মনে করেন ফজলুল হক।