রাশিয়ার ঋণ চীনা ইউয়ানে পরিশোধ, বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত কী বার্তা দিচ্ছে
রাশিয়ার অর্থে রূপপুরে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। তবে ঋণের অর্থ শোধ করা হবে ইউয়ানে, যা চীনা মুদ্রার আন্তর্জাতিক ব্যবহারের একটি নতুন পথ খুলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে ওই বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে সাউথ চায়না মনিং পোস্ট বলছে, বিশ্ব বাণিজ্যব্যবস্থা থেকে ডলারকে হটানোর ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ খুব বেশি কাজ করবে না। এর কারণ, বেইজিং তার আর্থিক ব্যবস্থা এবং মূলধনি হিসাব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশের একজন সরকারি কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সাউথ চায়না মনিং পোস্ট আরও জানিয়েছে, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধে ইউয়ান ব্যবহার করতে বাংলাদেশ ও রাশিয়া একমত হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উত্তম কুমার কর্মকার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, রাশিয়া চেয়েছিল ঋণের অর্থ রুবলে পরিশোধ করা হোক, ‘কিন্তু আমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়’।
দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথমটি বাংলাদেশ এখন নির্মাণ করছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত রসাটম এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। এর ৯০ শতাংশই আসছে রাশিয়ার ঋণ হিসেবে, যা পরিশোধ করতে হবে ২৮ বছরে। অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে ১০ বছর।
বাণিজ্য অর্থায়ন, আন্তর্জাতিক লেনদেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মজুত—এসব খাতে চীনের মুদ্রা এখন আগের তুলনায় বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে মার্কিন ডলারের চেয়ে এর পরিমাণ এখনো অনেক কম।
অনেক দেশ আবার মার্কিন ট্রেজারি বিল বিক্রি করে দিচ্ছে। তারা তাদের সোনার মজুত বাড়াচ্ছে, আর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করছে স্থানীয় মুদ্রা।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য তারা কোনো লক্ষ্য ঠিক করেনি। তবে গত বছর ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়াকে যেভাবে ডলার ব্যবস্থা থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাতে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে বেইজিং উদ্বিগ্ন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মঙ্গলবারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে চীনা কোনো প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা নেই এমন লেনদেনে এই মুদ্রা (ইউয়ান) যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পারে কি না।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীন সরাসরি জড়িত নেই বর্তমানে এমন (ইউয়ান নিয়ন্ত্রিত) লেনদেনের নজির খুব কমই দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত রাশিয়া এবং অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ছাড়া।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে লেনদেন নিয়ে প্রায় বছরব্যাপী অচলাবস্থা ছিল। ইউয়ানে লেনদেনের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে গেছে। গত বছর লেনদেনের বিশ্বব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার পর বাংলাদেশ ডলারে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে পারছিল না।
এখন আন্তব্যাংক লেনদেনব্যবস্থার মাধ্যমে ইউয়ান ব্যবহার করে এই অর্থ পরিশোধ করা হবে। চীন ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থা চালু করে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক আইএসইএএস-ইউসফইশহাক ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো জয়ন্ত মেনন বলেন, বাংলাদেশ ডলার ব্যবহার না করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ, মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে দেশটির মুদ্রার মানে বড় পতন হয়েছে এবং তার ডলারের মজুত কমে গেছে। এখানে দেশ-নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে।
তবে ইউয়ানকে সামনে ঠেলে দিতে বিষয়টি হয়তো চীনকে একটা পথ দেখাতে পারে। বিশেষ করে চীন নেতৃত্ব দেয় এমন প্রতিষ্ঠান ব্রিকস এবং চীনের নিজস্ব বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ক্ষেত্রে। ব্রিকস হলো পাঁচটি বড় অর্থনীতির দেশের জোট, যার সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ ব্রাজিলও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ইউয়ানে করতে কেবল রাজিই হয়েছে তা-ই নয়, তারা বরং ব্রিকস জোটের আরও বেশি লেনদেন স্থানীয় মুদ্রায় করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে চীন সফরের সময় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা ডি সিলভা বলেন, ‘লেনদেন করতে কেন সব দেশ মার্কিন ডলার ব্যবহার করবে। কেন ইউয়ান কিংবা অন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়। আমরা এখন একুশ শতকে আছি এবং আমরা ব্যতিক্রম কিছু একটা করতে পারি।’
তেলের ব্যবসায় যাতে ইউয়ান ব্যবহার করা যায়, সে জন্য বেইজিং এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। তেলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দশকের পর দশক ধরে মার্কিন ডলারে হয়ে আসছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দিতে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গত ডিসেম্বরে সৌদি আরব সফর করেন। চীন সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে সৌদি আরব থেকেই। ওই সফরের সময় সি বলেন, জ্বালানি সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন ব্যবস্থার উদ্ভাবন হওয়া উচিত।
জয়ন্ত মেনন বলেন, মার্কিন ডলারের ব্যবহার পরিহারের ব্যাপারে ব্রিকস জোটভুক্ত কিছু দেশের মধ্যে একটি প্রবণতা গড়ে উঠছে, তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং খুব কম মাত্রায় এটি ঘটছে।
জয়ন্ত মেনন আরও বলেন, আর্থিক খাত সংস্কারের আগে মূলধনি হিসাব সম্পূর্ণভাবে খুলে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মূলধনি হিসাব আরও উদারীকরণের আগে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজার শক্তিশালী করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবল ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণ বাড়বে। এটি খুবই লম্বা পথ।
নেটক্সিজের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ গ্যারি ইঙ বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববিহীন স্বায়ত্তশাসিত মুদ্রানীতি চীনের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগীদের মধ্যে ইউয়ানের প্রভাব বাড়াচ্ছে।
গ্যারি ইঙ বলেন, অনেক দেশকে ডলারে বাণিজ্য করতে হচ্ছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী নয়। ফলে কোনো কারণ ছাড়াই তাদের ওপর ডলার, অর্থাৎ মার্কিন মুদ্রানীতির প্রভাব পড়ছে। যদিও ব্রিকসের অর্থনীতি এখন জি-৭ (বিশ্বের সাতটি উন্নত অর্থনীতির জোট)-এর সঙ্গে তুলনীয়।
গ্যারি ইঙ বলেন, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা এবং ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে চীন আরও বড় একটি ভূমিকা চায়। অন্যদের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে যে বাণিজ্য এবং পুঁজির প্রবাহের ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং ভূরাজনৈতিক শক্তির লড়াইয়ে আরও ভালো অবস্থানের মাধ্যমে তারা ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চায়।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, লেনদেন এবং বাণিজ্যে ইউয়ানের গুরুত্ব সম্ভবত ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কিন্তু এটি মার্কিন ডলারকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত করতে পারবে না। এর কারণ, এর নিজস্ব ঝুঁকি এবং যথেষ্ট নগদ অর্থ না থাকার সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আর রয়েছে চীনের মূলধনি হিসাব নিরুদ্ধ থাকার বিষয়টি।
গ্যারি ইঙ বলেন, ডলারকে বাদ দেওয়া সব সময় ভালো কিছু না-ও হতে পারে। বেশির ভাগ ঋণই ডলারে। আর ডলার থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেশের দরকার এমন একটি মুদ্রার মজুত, যাতে বাজারের আস্থা এবং নগদ অর্থের ভালো প্রবাহ থাকে। অবাধ বিনিময়যোগ্যতার বিষয়টি ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে ডলার এখনো এক নম্বর পছন্দ।