এবার এস আলমমুক্ত হলো এসআইবিএল

মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম)

ইসলামী ব্যাংকের পর এবার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডও (এসআইবিএল) বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের রাহুমুক্ত হয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে একজন উদ্যোক্তা শেয়ারধারীকে পরিচালক এবং আরও চারজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। এভাবেই বেসরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার এক আদেশে বলেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে, যে সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।

একই আদেশে বলা হয়েছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিত করা ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠনের জন্য পাঁচজনকে পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালক হয়েছেন মো. রেজাউল হক। তিনি এই ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা শেয়ারধারী ও সাবেক চেয়ারম্যান। নতুন চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাকসুদা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম, রূপালী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোরশেদ আলম খন্দকার এবং হিসাববিদ মো. আনোয়ার হোসেন। নতুন এই পরিচালকদের মধ্য থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হবে।

আমরা শিগগির পর্ষদ সভা ডেকে ব্যাংকের পুনর্গঠন শুরু করব। ব্যাংকে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তার বিচার হবে। ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।
মো. রেজাউল হক, সাবেক চেয়ারম্যান, এসআইবিএল।  

জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান মো. রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিগগির পর্ষদ সভা ডেকে ব্যাংকের পুনর্গঠন শুরু করব। ব্যাংকে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তার বিচার হবে। ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পদক্ষেপের ফলে দ্বিতীয় ব্যাংক হিসেবে এসআইবিএল এস আলমমুক্ত হলো। এর আগে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ওই ব্যাংকটিতেও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকটি যেভাবে এস আলমের পকেটে

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আগের দিন রাতে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও কোম্পানি সচিবকে তুলে নিয়ে যায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা। ব্যাংকটি দখলের পর চেয়ারম্যান করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফকে। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ হচ্ছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা।

এসআইবিএলের মালিকানা পরিবর্তনের সময়ই এস আলম গ্রুপ কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালককে বাদ দেয়। এরপর তারা ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নেয়। যে কারণে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবেও ঘাটতিতে রয়েছে। এই ব্যাংকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

মালিকানা পরিবর্তনের সময় ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশই এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। এসব টাকা কীভাবে আদায় হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঋণের অর্ধেক টাকা এই একটি গ্রুপের কাছে আটকে যাওয়ায় ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপের ঋণও রয়েছে। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে প্রায় তিন বছর আগে চিনি ও তেল আমদানি করেছে, এখনো সেই অর্থ শোধ করেনি। নিয়মানুযায়ী এক বছরের মধ্যে এই অর্থ শোধ করার কথা। তবে এক বছরের মধ্যে অর্থ আদায় না করলেও চলবে—বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ক্ষমতাবলে ব্যাংকটিকে এই অনুমোদন দিয়ে রেখেছে।

ব্যাংকটি কীভাবে দখল হয়েছিল— জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর রাতে ব্যাংকের এমডি, ভাইস চেয়ারম্যান ও আমাকে ডেকে নিয়ে যান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁদের কার্যালয়ে আমাদের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। এরপর আমার সঙ্গে দেখা করেন সাইফুল আলম, তাঁর ভাই আবদুস সামাদ লাবু ও বেলাল আহমেদ। পরে সংস্থাটির মহাপরিচালক আমাকে জানান, ওপরের নির্দেশে এই মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এর পর থেকে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমরা পর্ষদ দ্রুত পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪০৪তম সভা নির্ধারিত ছিল মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে। সেদিন স্বৈরাচারী সরকারের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এস আলম এবং তাঁদের সহযোগীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ওই বাহিনীর কার্যালয়ে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। পরে পর্ষদের ওই সভা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পরিবর্তে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও পর্ষদের অন্য সদস্যদের জোরপূর্বক বাসা থেকে তুলে এনে প্রথমে গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে, পরে তাদের তত্ত্বাবধানে হোটেল ওয়েস্টিনে হাজির করা হয়।’

চিঠিতে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের সীমাহীন দুর্নীতি এবং নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যাংকের টাকা এস আলম গ্রুপ ও তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান নামে ও বেনামে উত্তোলন অব্যাহত রাখে, যা দ্রুত বন্ধ করা দরকার। না হলে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।

এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১১ আগস্ট সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছেন ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। এতে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা তাঁদের জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতেই গতকাল আগের পর্ষদ ভেঙে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।