২১ দিন ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ
পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকার দিনে তিন-চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে।
টানা ২১ দিন কাজ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন ছয় শতাধিক শ্রমিক।
টানা ২১ দিন ধরে মিয়ানমার থেকে কোনো পণ্যবোঝাই কার্গো ট্রলার বা জাহাজ আসছে না। সর্বশেষ ৪ জুন কাঠভর্তি একটি কার্গো ট্রলার এসেছিল কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে। আর এ বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ থেকে কোনো রপ্তানি পণ্য মিয়ানমারে যাচ্ছে না। এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির জান্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই-সংঘর্ষের ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
আগে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে ১০-১২টি ট্রলারে করে বিভিন্ন পণ্য আসত এবং ২-১টি ট্রলারে পণ্য সে দেশে যেত। এখন কোনোটাই হচ্ছে না।
সাধারণত মিয়ানমারের মংডু ও আকিয়াব বন্দর এবং বাংলাদেশের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে। টেকনাফ থেকে দেশটির রাজধানী ইয়াঙ্গুনের দূরত্ব প্রায় এক হাজার কিলোমিটার হওয়ায় সেখান থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যায়। আবার সময়ও লাগে বেশি। অন্যদিকে মংডুর অবস্থান টেকনাফের ঠিক উল্টো দিকে নাফ নদীর ওপারে, দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।
টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েক মাস আগেও মিয়ানমারের মংডু ও আকিয়াব থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি ট্রলারে করে নারকেল, পেঁয়াজ, আদা, আচার, কাঠ, শুকনা সুপারি, শুঁটকি, হিমায়িত মাছসহ বিভিন্ন পণ্য টেকনাফ স্থলবন্দরে আসত। সর্বশেষ ৪ জুন কাঠ নিয়ে একটি ট্রলার আসে। এ ছাড়া ২ জুন একটি ট্রলারে হিমায়িত মাছ ও ২২ মে একটি ট্রলারে করে নারকেল, আদা, আচার, সুপারি ও শুঁটকি আমদানি হয়।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শ্রমিকনেতা আজগর আলী ও শামসুদ্দিন জানান, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে থেকে দিনে ২-১টি ট্রলারে করে কাপড়, আলু, কোমল পানীয় ও প্লাস্টিকজাতীয় পণ্য মিয়ানমারে রপ্তানি হতো।
এদিকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা বি এম আবদুল্লাহ আল মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সরকার দিনে তিন-চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কবে আবার স্বাভাবিক হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
সীমান্তে চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের টেকনাফ ও মিয়ানমারের মংডুর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা হয়েছিল।
সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার টেকনাফ স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, জেটি ফাঁকা পড়ে আছে। কোনো কার্গো ট্রলার বা জাহাজ নেই। সে জন্য শ্রমিকেরা অলস সময় পার করছেন। স্থলবন্দরটিকে কেন্দ্র করে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পাশে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে।
স্থলবন্দরের শ্রমিকনেতা আলী আজগর মাঝি বলেন, বন্দরে মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য ছয় শতাধিক শ্রমিক রয়েছেন। টানা ২১ দিন কাজ বন্ধ থাকায় তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।
মিয়ানমার থেকে হিমায়িত মাছ আমদানিকারক এম কায়সার জানান, আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিয়ানমারে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু পণ্যসামগ্রী আটকা পড়েছে। এর মধ্যে হিমায়িত মাছসহ পচনশীল নানা পণ্যও রয়েছে। এসব পণ্য সময়মতো আনতে না পারলে ব্যবসায়ীদের বড় লোকসান হবে।
ব্যবসায়ী ওমর ফারুক জানান, মিয়ানমারে তাঁর ১ হাজার ৩০০ টন আদা, দেড় হাজার টন শুঁটকি ও ৭০০ টন শুকনা সুপারি আটকে আছে। এসব পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওমর ফারুক আরও জানান, গত বছর তিনি একাই সরকারকে ৩০০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব দিয়েছেন। এবারও এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব দিয়েছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, টেকনাফ-সেন্টমাটিন নৌ রুটের নাইক্ষ্যংদিয়া নামের এলাকায় মিয়ানমারের দিক থেকে ইতিমধ্যে কয়েক দফায় বাংলাদেশি ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটেছে। তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে স্থানীয় প্রশাসন ওই নৌ রুট দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুর রহমান বলেন, মাঝেমধ্যে ইয়াঙ্গুন থেকে পণ্যবাহী কিছু ট্রলার এলেও এখন সেটিও বন্ধ রয়েছে।