রেস্তোরাঁয় আরেক দফা বাড়ছে খাবারের দাম

সাধারণ মানের একটি রেস্তোরাঁয় এখন ১টি ডিমভাজি, ডাল আর ১ প্লেট ভাত খেতে শ্রমজীবী একজনকে গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা।

ছবি: প্রথম আলো

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। এতে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ—সবখানেই খাবারের খরচ এখন বাড়তি। বাজারে মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁয় আরেক দফা বেড়েছে খাবারের দাম। যাঁরা নিয়মিত রেস্তোরাঁয় খান, তাঁদের এখন শুধু ডাল, ডিমভাজি ও ১ প্লেট ভাত খেতেই গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকার বেশি। এমনিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লোকজন নানাভাবে খরচ কমাচ্ছেন। রেস্তোরাঁয় খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এখন রেস্তোরাঁর খাবারের দাম বাড়ায় এ খাতের ব্যবসায় পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মিরপুর-১, কল্যাণপুর, শ্যামলী, ধানমন্ডি ও পান্থপথের প্রায় ১৫টি রেস্তোরাঁ ঘুরে জানা যায়, ৫ আগস্ট জ্বালানির দাম বাড়ানোর পর নতুন করে বাজারে ডিম, চাল, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। বাড়তি এ দামের কারণে রেস্তোরাঁগুলোও খাবারের দাম সমন্বয় করতে শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে প্রথম দফায় বাড়ানো হয়েছে রান্না করা ডিম ও মুরগির মাংসের দাম। আবার কোনো কোনো রেস্তোরাঁ অন্য তরকারির দামও বাড়াতে শুরু করেছে। শুধু দাম বাড়িয়েই বাড়তি খরচ যে সমন্বয় করা হচ্ছে তা নয়, অনেক রেস্তোরাঁ মাছ-মাংসের টুকরাও ছোট করে ফেলেছে।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে কয়েকটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, মানুষ রেস্টুরেন্টে খাওয়া কমিয়ে দেয়; দ্বিতীয়ত, রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ে।
ফারুক আহমেদ, রেস্টুরেন্টের মালিক

রাজধানীর পাঁচটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ মানের রেস্তোরাঁগুলোতে ডিমের দাম বাটিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর ডিমভাজির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ২০ টাকায়। এতে সকালের নাশতায় ২টি রুটি আর ১টি ডিম খেলে লাগছে ৪০ টাকা। অন্যদিকে ১ প্লেট ভাত, ১টি ডিম ও ১ বাটি ডাল খেলে লাগছে ৫০ টাকা। এই প্যাকেজ খেতে আগে লাগত ৩৫ টাকা। এর বাইরে পদভেদে মুরগির ঝালফ্রাই, আলু দিয়ে রান্না করা মুরগির মাংসের দাম রেস্তোরাঁভেদে প্রতি বাটিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সমপরিমাণে বেড়েছে মুরগির রোস্টের দামও। রেস্তোরাঁভেদে মুরগির নানান পদ এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১১০ টাকায়।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিরপুর-১-এ কথা হয় তৈরি পোশাকশ্রমিক আকবর আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মূলত সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার বাইরেই খাই। আর রাতে ফিরে রান্না করি। দুই বেলা রেস্তোরাঁয় খেতে আমার বাজেট ১০০ টাকা। এখন সেখানে লাগছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। তাতে আমার মাসে প্রায় ১ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হবে।’

নিম্নবিত্ত ও কম বেতনের বেসরকারি চাকরিজীবী ও পরিবহনশ্রমিকেরা নিয়মিত খান এমন কিছু রেস্টুরেন্ট ঘুরে জানা যায়, সেখানে প্রতি প্লেট ভাতের দাম এখন ১৫ থেকে ২০ টাকা, একটা সাধারণ মানের ভর্তা ১০ টাকা, সাধারণ সবজি ২০ থেকে ৩০ টাকা, করলাভাজি ৩০ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা, মাছের বিভিন্ন পদ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৯০ টাকায়। আর অনেক রেস্টুরেন্টের বিনা মূল্যের পাতলা ডাল এখন ১০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হচ্ছে।

দুই বেলা রেস্তোরাঁয় খেতে আমার বাজেট ১০০ টাকা। এখন সেখানে লাগছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। তাতে আমার মাসে প্রায় ১ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হবে।
আকবর আলী, পোশাকশ্রমিক

এদিকে ধানমন্ডি, পান্থপথ ও কলাবাগানে মাঝারি মানের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ১ বাটি গরুর মাংস ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা, মুরগির মাংস ১১০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১২০ টাকার মুরগির বিরিয়ানির দামও ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা। ধানমন্ডির জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন আফতাব রেস্টুরেন্টের মালিক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে কয়েকটা সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, মানুষ রেস্টুরেন্টে খাওয়া কমিয়ে দেয়; দ্বিতীয়ত, রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ে। খাবারের দাম বাড়ার কারণেও ক্রেতা কমে যায়। এতে আমাদের ব্যবসা দিন দিন খারাপ হয়। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে এভাবে কত দিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারব, সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’

খাবারের দাম বাড়ায় ক্রেতা কমেছে উল্লেখ করে পান্থপথে মা রেস্টুরেন্টের বিক্রয়কর্মী আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ মানের একটা চিকেন ফ্রাই আমরা আগে ৬০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন সেটি বিক্রি করছি ৭০ টাকায়। ৫০ টাকার পাস্তা এখন বিক্রি করছি ৬০ টাকায়। ফ্রায়েড রাইসের দামও বাড়িয়েছি ১০ টাকা। বাজারে জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমরা দাম না বাড়ালে টিকতে পারব না।’

একটি রেস্তোরাঁ চালাতে যেসব নিত্যপণ্যের প্রয়োজন হয়, তার প্রায় সব কটির দামই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর নতুন করে আবার বেড়েছে। এতে রেস্তোরাঁর মালিকেরাও খাবারের দাম বাড়াতে শুরু করেছেন। আর ভুক্তভোগী হচ্ছেন বাধ্য হয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে আসা শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের লোকজনকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও হুট করে খাবারের দোকানে দাম বাড়ানো যায় না। কারণ, ক্রেতারা এটা স্বাভাবিকভাবে নেন না। এতে ব্যবসায়ীরা প্রথমে পরিমাণ কমান। এরপর দাম বাড়ান। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে আমরা রেস্তোরাঁর মালিকেরা চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে সভা করব।’

২০২১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের করা এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে হোটেল-রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪। এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৪। এই খাতে এক দশকে কর্মসংস্থানও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য। এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩২ জনের। যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৮ লাখ ৩৭ হাজার। বাকিরা নারী। এক দশক আগে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে কর্মসংস্থান ছিল ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪ জনের।