এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন
ভোটের লড়াইয়ে ‘প্রভাবশালী প্যানেলের’ ভরাডুবি কেন
চমক দেখিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ পদ নিজেদের ঘরে তুলেছে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ। এ বিজয়ের পেছনে পাঁচটি কারণের কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোটের আগেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, লড়াই হবে সমানে সমান। ভোটের দিন কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই ভোটকেন্দ্রের ভেতরে জোরালো কানাঘুষা শোনা যায়, ভোট ভাগ হচ্ছে, ফলাফলে বড় চমক আসবে। শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলে ‘প্রভাবশালী প্যানেল’ হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের একরকম ভরাডুবি হয়েছে। চমক দেখিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ পদ নিজেদের ঘরে তুলেছে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) ২০২৩-২৫ মেয়াদের পর্ষদের একাংশ, অর্থাৎ অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ২৩ পরিচালক পদের ১৫টিতে জয়ী হয়েছেন সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের প্রার্থীরা। তাঁদের মধ্যে সাতজন সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন আটটি পদে। এই প্যানেলের একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থীও জয়ী হতে পারেননি। তাঁর মধ্যে রয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সহসভাপতি এম এ মোমেনও।
ভোটের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন প্যানেলের ভরাডুবির বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার সারা দিন ব্যবসায়ী মহলে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। যদিও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, একটি পরিবর্তন দরকার ছিল।
প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক উভয় প্যানেলের একাধিক প্রার্থী, সমর্থক ব্যবসায়ী নেতার পাশাপাশি কয়েকজন সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে হেরেছে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ। প্রথমত, প্যানেল গঠনে যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতি বা প্রভাবশালীদের সুপারিশকে বেশি আমলে নেওয়া হয়েছে। যাঁদের অনেককে চেনেন না সাধারণ ভোটাররা। দ্বিতীয়ত, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা এই প্যানেলের প্রতি জোরালো সমর্থন জানান। সে কারণে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাস ছিলেন প্রার্থীরা। কিন্তু তাঁরা সাধারণ ভোটারদের কাছে যাননি। তৃতীয়ত, ক্ষমতাসীন প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে সরকারবিরোধী মনোভাবও কাজ করেছে।
চতুর্থত, মাহবুবুল আলম প্যানেল লিডার হলেও ভোটের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি গত দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিভিন্ন সভায় পুরান ঢাকার কয়েকজন প্রবীণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে রূঢ় ভাষায় কথা বলেন। বিরোধী প্যানেল বিষয়টিকে সামনে এনে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সহানুভূতি আদায় করে। এ ছাড়া সম্মিলিত পরিষদকে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলে ফাহিম। প্রভাবশালী প্যানেলের বিপরীতে ফাহিমের সমর্থন সম্মিলিত পরিষদের ভোট বাড়াতে সহায়তা করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নেতা গতকাল বলেন, ভোটের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদে সমন্বয়হীনতা ছিল। প্রথমে ৫২ জন ব্যবসায়ীকে মনোনয়নপত্র কিনতে বলা হয়। যদিও শেষ মুহূর্তে ১৩ জনকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে নিষেধ করা হয়। মনোনয়নপত্র জমা দেন ৩৯ জন। পরে ১৬ জনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো হয়। এই মনোনয়নবঞ্চিতদের কেউ কেউ রাগে-ক্ষোভে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের পক্ষে কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ২৩ পদের জন্য ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্যানেলে সাবেক এরশাদের শাসন আমলের অর্থ উপমন্ত্রী এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুনশীর ছেলে রাকিব মো. ফখরুল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে রাশেদুল হোসেন চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছেলের বউ মানতাশা আহমেদ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের জামাতা এজাজ মোহাম্মদ ও সরকারের শীর্ষ পদের আত্মীয় পরিচয়ে কাজী এরতেজা হাসান মনোনয়ন পান। তাঁদের মধ্যে শুধু রাশেদুল হোসেন চৌধুরী বিজয়ী হন।
ভোটে এমন ভরাডুবির কারণ জানতে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্যানেল লিডার মাহবুবুল আলমের সঙ্গে প্রথম আলো থেকে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি। অন্যদিকে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদের আহ্বায়ক মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্যানেলের মধ্যে একটা টিম স্পিরিট ছিল। নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে সাধারণ ভোটাররা আমাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিয়েছেন।’ ঐক্য পরিষদের ভরাডুবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের প্যানেলে আত্মীয়স্বজন ও বড়লোক ব্যবসায়ীদের প্রার্থী করা হয়। অথচ তাঁরা সব ভোটারের কাছেও যাননি।
জয়ী হলেন যাঁরা
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গত সোমবার অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ২৩ পদের নির্বাচনে ৮৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। ২৩ পদের জন্য সমানসংখ্যক প্রার্থী দেয় ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদ ও সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ। তার বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন তিনজন।
নির্বাচিতদের মধ্যে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ থেকে মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহ ১ হাজার ২৯৪ ভোট, বি এম শোয়েব ১ হাজার ২৭৯, মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ ১ হাজার ২৫৭, সিরাজুল ইসলাম ১ হাজার ২৪৬, মো. সহিদুল হক মোল্যা ১ হাজার ২১৫, নিজাম উদ্দিন রাজেশ ১ হাজার ১৯১, মো. মুনতাকিম আশরাফ ১ হাজার ১৭৫, রাকিবুল আলম ৯৯২, মোহাম্মদ আফতাব জাভেদ ৯৬৬, মো. ইসহাকুল হোসেন ৮৯১, আমির হোসেন নূরানী ৮৫২, সৈয়দ মো. বখতিয়ার ৮৪০, তপন কুমার মজুমদার ৮৩৫, সালমা হোসেন ৮৩১ ও মো. আবুল হাশেম ৮১৫ ভোট পেয়ে পরিচালক নির্বাচিত হন।
অন্যদিকে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের নির্বাচিতদের মধ্যে কাওসার আহমেদ ১ হাজার ৩০ ভোট, খন্দকার রুহুল আমিন ৯৮৮, মো. আমিন হেলালী ৯১১, মো. নিয়াজ আলী চিশতী ৯০৯, আবু মোতালেব ৮৯৯, শমী কায়সার ৮৫২, রাশেদুল হোসেন চৌধুরী ৮৩৭ ও হাফেজ হারুন পেয়েছেন ৮১৩ ভোট।
সহসভাপতি পদে কারা
ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্যানেল লিডার মাহবুবুল আলম এফবিসিসিআইয়ের পরবর্তী সভাপতি হচ্ছেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ভোটের আগেই সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচিত ও মনোনীত ৫৫ পরিচালক এই প্যানেলের পক্ষের। এফবিসিসিআইয়ের মোট পরিচালক পদ ৮০টি। সোমবারের ভোটের ফলাফলের পর হিসাব–নিকাশ কিছুটা বদলে গেছে। সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ থেকে বিজয়ী একাধিক প্রার্থী সহসভাপতি পদের নির্বাচনে অংশ নেবেন। এমন ইঙ্গিত গতকাল দিয়েছেন প্যানেলটির আহ্বায়ক। আজ বুধবার বিকেলে সভাপতি ও সাত সহসভাপতি পদের নির্বাচন। যদিও সহসভাপতি পদে কারা আসবেন, সেটি নিয়ে উভয় প্যানেলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সমঝোতাও হতে পারে।