যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রম অধিকার লঙ্ঘন হয়, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম
বিশ্বের যেসব দেশে শ্রম অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। এই কাতারে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে আফগানিস্তান, জর্ডান ও জিম্বাবুয়ে।
অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে নিচের ১০টি দেশের কাতারে। এই সূচকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১তম। সেই সঙ্গে শ্রমিকের অধিকার রক্ষায়ও বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে তলানির ১০ দেশের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল গতকাল সোমবার যৌথভাবে ‘দ্য কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইক্যুয়ালিটি (সিআরআই) ইনডেক্স ২০২৪’ বা ‘অসমতা হ্রাসের অঙ্গীকার সূচক’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উঠে এসেছে।
দেখা যাচ্ছে, অসমতা হ্রাসের অঙ্গীকার সূচকে বাংলাদেশ চলতি ২০২৪ সালে ১৭ ধাপ পিছিয়ে ১২৪তম স্থানে নেমে গেছে। ২০২২ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৭তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ১৪৮তম ও ২০২০ সালে ১১৩তম স্থানে ছিল।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য কমানোর তৎপরতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশ অসমতা হ্রাসে বিভিন্ন দিক থেকেই পিছিয়ে আছে। সেই সঙ্গে যেসব দেশে শ্রম অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
* সিআরআই সূচকের তিন মানদণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি সেবায় ১৩৫তম, করনীতিতে ৭১ ও শ্রমে ১১৮তম হয়েছে।
* দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ১২৭তম, পাকিস্তান ১৪১তম, মালদ্বীপ ৬৬তম, নেপাল ১১৫তম, শ্রীলঙ্কা ১১৮তম স্থানে রয়েছে।
২০২৪ সালের প্রতিবেদনটিতে আরও দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। ৮১ শতাংশ দেশ অনুক্রমিক করব্যবস্থা (প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স) থেকে, অর্থাৎ ধনীদের ওপর অধিক হারে করারোপের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। ৯০ শতাংশ দেশ শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি প্রণয়ন ও মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করা ও আয় বণ্টনে পিছিয়েছে।
এবারের সূচকে শুধু বাংলাদেশ নয়, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা ও ইউনিয়ন করার আইন প্রণয়ন ও চর্চার ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ দেশ পিছিয়েছে। তবে অনেক দেশ আবার উন্নতি করেছে। তেমনই এক দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২২ সালের পর দেশটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি গ্রহণ করে এগিয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি কম। এমনকি বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও এই খাতের শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয়, তাতেও তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছেন। খাতটির এত উন্নতি হলেও শ্রমিকদের শোভন জীবনযাপন নিশ্চিত করা যায়নি। সেই সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার প্রতিনিয়তই লঙ্ঘিত হয়। ফলে এই সূচকে যে বাংলাদেশ সবার নিচের সারিতে, তা অপ্রত্যাশিত নয়; বরং দুঃখজনক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের পর বিশ্বের যেসব দেশে করপোরেট আয়কর কমেছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, পাকিস্তান, জাম্বিয়া, তুরস্ক। কিন্তু এ সময়ে বাংলাদেশের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট হারে পরিবর্তন আনা হয়নি, অর্থাৎ করপোরেট করহার কমিয়ে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হলেও ভ্যাট কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া হয়নি।
বিষয়টি হলো, ভ্যাট ধনী-গরিব সবাই একই হারে দেন। এটা পরোক্ষ কর। বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের গড়ে ৭০ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে আসে, অর্থাৎ অবস্থাপন্ন মানুষের কাছ থেকে যে হারে কর আদায় করা উচিত, বাংলাদেশে সেই হারে তা করা হয় না।
অক্সফামের প্রতিবেদনে মোট তিনটি বিষয়ের নিরিখে সিআরআই সূচক তৈরি করেছে। এগুলো হলো সরকারি সেবা, করনীতি ও শ্রম। এই তিন ক্ষেত্রের মধ্যে সরকারি সেবায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫, কর নীতিতে ৭১ ও শ্রমে ১১৮।
অক্সফামের ২০২৪ সালের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১২৭তম, পাকিস্তান ১৪১তম, মালদ্বীপ ৬৬তম, নেপাল ১১৫তম, শ্রীলঙ্কা ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রায় ক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা গেছে। মানব উন্নয়ন সূচকগুলো উন্নত হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলেন, চিত্তাকর্ষক এই প্রবৃদ্ধির পেছনে একটি অন্ধকার দিক রয়েছে। সেটা হলো ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, আয়ের জিনি সহগ (আয়বৈষম্যের একটি জনপ্রিয় পরিমাপ) ২০০০ সালে শূন্য দশমিক ৪৫০ থেকে ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯-তে উন্নীত হয়েছে। সম্পদের বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ।
অসমতা প্রসঙ্গে সেলিম রায়হান বলেন, অসমতা যে বাড়ছে, তা অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু অসমতা প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো দুর্বল। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যা আছে, তা–ও যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে ধনীদের ওপর এ দেশে অনুক্রমিক (প্রগ্রেসিভ) হারে করারোপ করা হয় না। ধনীদের কর ফাঁকির সুযোগ থাকলেও দরিদ্রদের তা নেই। বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ কর তাঁদের দিতেই হয়।