১০% ধনীর হাতে ৪১% আয়
দেশের মোট আয়ে ধনীদের অংশ বাড়ছে। ফলে আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। উচ্চ বৈষম্যের দেশের দ্বারপ্রান্তে দেশ।
দেশে আয়বৈষম্য আরও বেড়েছে। ধনীদের আয় আরও বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, গত ৫০ বছরে ধনীদের আয় অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ধনী ও গরিবের আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে এই চিত্র উঠে এসেছে।
গত এক যুগে দেশে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, সঙ্গে দ্রুতগতিতে বৈষম্যও বেড়েছে। বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক এখন দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ উচ্চ বৈষম্যের দেশ থেকে অতি সামান্য দূরত্বে আছে বাংলাদেশ।
সাধারণত গিনি (কেউ কেউ জিনি বলেন) সহগ দিয়ে একটি দেশে আয়বৈষম্য কেমন, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। এটি বৈষম্য মাপার একটি পদ্ধতি। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি বা জিনি এর উদ্ভাবক। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক হবে শূন্য। এর অর্থ হলো চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। এটি আবার চরম অসাম্য অবস্থা। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি। বাংলাদেশে এই বৈষম্য দিন দিন বেড়েছে।
সব মিলিয়ে এবারের জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি এক ভাগ।
দেশে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন হাজার ডলারের কাছাকাছি। ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের হিসাবে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হবে ২০২৬ সালের পর। সুতরাং অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। অতি ধনী শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। বৈধ-অবৈধভাবে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন একশ্রেণির মানুষ।
কেন বৈষম্য বাড়ছে—এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শহরের শ্রমিকদের আয় সেভাবে বাড়েনি। জমি বা সম্পদের মালিকেরাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বেশি পাচ্ছেন। গত ছয় বছরে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। অথচ এই সময়ে শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মজুরিও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা; কিন্তু তা হয়নি। এই প্রবৃদ্ধিতে মালিকদের আয় বেড়েছে। ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তাঁরা মাফ পেয়ে গেছেন। করসুবিধা শিল্পমালিকেরাই পেয়েছেন। সার্বিকভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধায় মালিকেরা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকেরা কিছু পাননি। তাঁদের কাছে প্রবৃদ্ধির কোনো সুফল যায়নি। এভাবেই বৈষম্য বেড়েছে। তাঁর মতে, কোভিডের কারণে শহরে কাজ হারিয়ে অনেক শ্রমিক গ্রামে চলে গেছেন। সেখানে কম মজুরির কৃষি খাতে যোগ দিয়েছেন। তাতেও বৈষম্য বেড়েছে।
বৈষম্য কমাতে আমাদের পরিকল্পনা হলো, আগে সম্পদ সৃষ্টি করছি, তারপর সেই সম্পদের সুফল গড়িয়ে গড়িয়ে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব জায়গায় পৌঁছে যাবে। গরিব মানুষের আয় বাড়বে। এতে বৈষম্য কমবে, দারিদ্র্য কমবে। আমরা এখন সেই কৌশলেই এগিয়ে যাচ্ছি
ধনীদের আয় শুধু বেড়েছে
বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো খানার আয় ও ব্যয় জরিপ করা হয়। ওই জরিপের ফল অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ওই সময়ে দেশের মোট আয়ের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ আয় করত। পরের ১৫ বছরে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরের চতুর্থ খানার আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় কিছুটা বেড়ে হয়েছে মোট আয়ের ৩১ শতাংশ, আর ২০১০ সাল পর্যন্ত তা আরও বেড়ে হয় প্রায় ৩৬ শতাংশ।
এরপর থেকে দেশের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির আয়ের অংশীদারত্ব দ্রুত বেড়েছে। যেমন ২০১৬ সালে দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই ছিল শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। এবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির গিনি সহগ সূচক দশমিক ৬৫। আর সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে আছে সুইডেন, ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। এসব দেশে গিনি সহগ সূচক ৩০-এর আশপাশে।
অন্যদিকে স্বাধীনতার পর এই গরিব মানুষের আয় দেশের মোট আয়ে অংশীদারত্ব এখনকার চেয়ে ভালো ছিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ২ দশমিক ৮০ শতাংশের মতো আয় করত সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। পরের ১০-১২ বছরে এই অংশ কিছুটা বেড়েছে। এরপর ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এখন তা ওই সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় কমে মোট আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ হয়েছে। অবশ্য ২০১৬ সালে তা আরও কমে ১ শতাংশে নেমেছিল।
সব মিলিয়ে এবারের জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি এক ভাগ।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়নের এই পর্যায়ে বৈষম্য একটু বাড়ে। বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়টি এখন গভীর ও মৌলিক ইস্যু। বৈষম্য কমাতে আমাদের পরিকল্পনা হলো, আগে সম্পদ সৃষ্টি করছি, তারপর সেই সম্পদের সুফল গড়িয়ে গড়িয়ে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব জায়গায় পৌঁছে যাবে। গরিব মানুষের আয় বাড়বে। এতে বৈষম্য কমবে, দারিদ্র্য কমবে। আমরা এখন সেই কৌশলেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
উচ্চ বৈষম্যের সামান্য দূরে দেশ
১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল মাত্র দশমিক ৩৬। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৩৭। এর মানে হলো, ওই সময়ে দেশে দারিদ্র্য বেশি থাকলে আয়বৈষম্য ছিল তুলনামূলকভাবে সহনীয়। গত দেড় যুগে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০১০ সালে গিনি সহগ সূচক ছিল দশমিক ৪৫৮। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৪৮৩। সর্বশেষ ২০২২ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই একটি দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ এখন উচ্চ বৈষম্যের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির গিনি সহগ সূচক দশমিক ৬৫। আর সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে আছে সুইডেন, ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। এসব দেশে গিনি সহগ সূচক ৩০-এর আশপাশে। এ ছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর গিনি সূচক ৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে আছে।