কেমন করছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকাফাইল ছবি: এএফপি

স্থিতিশীল হচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দুই বছর আগে যে চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটি। মূল্যস্ফীতির হারও এরই মধ্যে কমে এসেছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার পর তাদের সামনে বিদেশি ঋণের সংকট মোকাবিলার নতুন পথ তৈরি হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বেড়েছে।

গত জুন মাসে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ছিল ২ দশমিক ৪০ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠেছিল।

এদিকে আইএমএফের ঋণ পাওয়ায় শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। গত মাসের শেষে দেশটির রিজার্ভ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৫৬০ কোটি ডলার, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৪৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ সাত মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১২০ কোটি ডলারমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া।

২০২২ সালে প্রতি ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময় মূল্য ৩৬৩-তে উঠে যায়; গত বছর তা ৩২০ রুপিতে নেমে আসে। এখন তা ২৯৭ রুপিতে নেমে এসেছে।

এসব কিছুর সম্মিলিত ফল হলো টানা তিন প্রান্তিকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। টানা পাঁচ প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার পর ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। তখন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। সে বছরের শেষ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি–মার্চ) প্রবৃদ্ধির হার আরও বেড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়। টানা দুই বছর অর্থনৈতিক সংকোচনের পর চলতি বছর সামগ্রিকভাবে দেশটি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

এখন শ্রীলঙ্কার জন্য সবচেয়ে সুখকর বিষয় হলো তারা সম্প্রতি বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ পেয়েছে। জুন মাসের শেষ দিকে সব মিলিয়ে ৫৮০ কোটি বা ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পুনর্গঠন করেছে দেশটি। ফলে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দুই বছর আগে যে ঋণখেলাপির খাতায় ঢুকে গিয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশটি।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এ ঋণ পুনর্গঠনসংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে। ভারত, জাপান ও ফ্রান্সের কাছ থেকে যে ঋণ তারা নিয়েছিল, তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী শিহান সেমাসিংহে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, শ্রীলঙ্কার ঋণ সংকট সমাধানে এ চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে।

২০২২ সালে অর্থনৈতিক সংকটে রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম তখন আকাশ ছুঁয়ে যায়; জ্বালানিসংকট চরমে পৌঁছায়; পেট্রলপাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে। গণরোষের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে।

রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন শুরু করে শ্রীলঙ্কা। বেশ কিছু নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে এর ফল পেতে শুরু করে দেশটি। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে। মূলত এই দুটি নীতি–পদক্ষেপের ফলেই ঘুরতে শুরু করে দেশটির অর্থনীতির চাকা। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশটিকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

সেই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাঁকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি যে দুটি খাতে হাত দেন, তা হলো নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানেও কারসাজির কারণে মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে মুদ্রার বিনিময় হার ওঠানামা করলেও নীতি সুদহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর নীতি সুদের রাশ ছেড়ে দেওয়া হয়।

ঋণ পুনর্গঠনের কারণে বিদ্যমান ঋণ পরিশোধ পিছিয়ে গেছে। ফলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কিছুটা দম নেওয়ার ফুরসত পাবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যে একেবারে সংকট থেকে বেরিয়ে এসেছে, তা নয়। আজ হোক বা কাল হোক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলো এখন শ্রীলঙ্কার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবে না, সেটিও ইতিবাচক দিক।

আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে মিলে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব কার্যক্রম দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও সেগুলো সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা এখন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হওয়ায় তারা সঠিক পথেই আছে।