আর্থিক খাত ও বিমা ব্যবসায় আসছে ইউনাইটেড পরিবার

  • ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের প্রায় ৩৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৯০ কোটি টাকায়।

  • ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের সোয়া ৫৩ শতাংশ শেয়ারের দাম ৮৪ কোটি টাকা।

  • কোম্পানি দুটির উদ্যোক্তা শেয়ারধারী ছিল ডানকান ব্রাদার্স ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

  • শেয়ারের হাতবদল প্রক্রিয়া শেষে কোম্পানি দুটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে।

শেয়ারবাজারপ্রতীকী ছবি

ব্যাংকবহির্ভূত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি বিমা কোম্পানির মালিকানায় যুক্ত হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপের তিন মালিক পরিবারের সদস্যরা। এরই মধ্যে এই দুই কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মালিকানার অংশ কিনে নিয়েছেন তাঁরা। জানা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা এসব শেয়ার কিনেছেন।

ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্স—দুটিই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। কোম্পানি দুটির উদ্যোক্তা ছিল বিদেশি ডানকান ব্রাদার্স ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এখন এই উদ্যোক্তাদের শেয়ারের বড় অংশ কিনে নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের তিন মালিক পরিবারের সদস্যরা। শেয়ার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় মালিকানা বদলের বিষয়টি কোনো পক্ষ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি। তবে ডানকান ব্রাদার্স ও তার সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোম্পানি দুটির শেয়ার বিক্রির কথা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের সোয়া ৫৩ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন ইউনাইটেড গ্রুপের অন্যতম মালিক হাসান মাহমুদ রাজা, আকতার মাহমুদ এবং কে এম এ শামীম পরিবারের সদস্যরা। এই দুই কোম্পানিতে তাঁরা প্রায় পৌনে দুই শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের শেয়ার কিনতে প্রায় ৯০ কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের শেয়ার কিনতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ও নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ৬ কোটি ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৭টি শেয়ার কিনে নিচ্ছেন ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১০ ব্যক্তি। তাঁরা হলেন ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ, গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট নিজামউদ্দিন হাসান রশিদ, মেহেনুর সুলতানা রশিদ, নাজমুল হাসান, সরফুদ্দিন আকতার রশিদ, আকতার মাহমুদ, কুতুবউদ্দিন আকতার রশিদ, খন্দকার মঈনুল আহসান, খন্দকার জায়েদ আহসান ও খন্দকার জাহিন আহসান।

শেয়ারধারণসংক্রান্ত নথিপত্র অনুযায়ী, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের উদ্যোক্তা শেয়ারধারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিকানা ছিল লরি গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির হাতে ছিল প্রায় পৌনে চার কোটি শেয়ার। ইউনাইটেড গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট পাঁচ ব্যক্তি এই শেয়ার কিনছেন। এর বাইরে উদ্যোক্তা অংশের প্রায় দেড় কোটি শেয়ার ছিল সুরমা ভ্যালি টি কোম্পানির নামে। ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশনের নামে ছিল ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার শেয়ার। এ ছাড়া ২১ লাখ ৪৪ হাজার শেয়ার ছিল ম্যাকালমস বাংলাদেশ ট্রাস্ট, আর ৫৪ লাখ ২৩ হাজার শেয়ার ছিল দ্য লুংলা টি কোম্পানি, চাঁদপুর টি কোম্পানি, ডানকান ব্রাদার্স, ডানকান প্রোডাক্টস, চিটাগাং ওয়্যার হাউসসহ নয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সিংহভাগ শেয়ারই ইউনাইটেড গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিনে নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরু থেকে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। দীর্ঘ আলোচনা শেষে শেয়ারের দরদাম নির্ধারণের পর দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। গত জুলাইয়ের মধ্যে শেয়ার হাতবদল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গণ–আন্দোলনের কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে কয়েক মাস বিলম্ব হয়।

অন্যদিকে ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের উদ্যোক্তাদের প্রায় ২ কোটি ৩৭ লাখ শেয়ার বিক্রি হচ্ছে। এসব শেয়ারের মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪৪ লাখ শেয়ার ছিল ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশনের নামে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার শেয়ার ছিল ম্যাকালমস বাংলাদেশ ট্রাস্টের নামে। বাকি শেয়ারের মালিকানা ছিল আমো টি কোম্পানি, আলয়নাগার টি কোম্পানি, চাঁদপুর টি কোম্পানি, মাজদি টি কোম্পানি, লুংলা টি কোম্পানি, ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ, অক্টোভিয়ার্স স্টিল এবং ডানকান প্রোডাক্টসের নামে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশে চায়ের ব্যবসার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানিসহ আরও কিছু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল ডানকান ব্রাদার্স ও সহযোগী বিভিন্ন কোম্পানি। মূল ব্যবসা অর্থাৎ চায়ের ব্যবসায় বেশি মনোযোগী হতে অন্যান্য ব্যবসা থেকে তারা সরে আসতে চায়। কিন্তু নানা সময় উদ্যোগ নিয়েও অন্যান্য ব্যবসার মালিকানা বদল সম্ভব হয়নি।

ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের শেয়ার কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের প্রতি অঙ্গীকার ও আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা এই দুই কোম্পানিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোম্পানি দুটির মালিকানায় ছিল বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং বাজারে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সুনামও রয়েছে। তাই আমরা বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি দুটিকে বেছে নিয়েছি।’

জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের পর শেয়ার হাতবদলের পুরো প্রক্রিয়া শেষে দুই কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে। পরিচালনায় যুক্ত হবেন নতুন শেয়ারধারীরা। এর মাধ্যমে ইউনাইটেড গ্রুপের সদস্যরা সরাসরি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানির পরিচালনায় যুক্ত হবেন। বর্তমানে এ গ্রুপের সদস্যরা বিদ্যুৎ, আবাসন, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চেইনশপসহ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

এ বিষয়ে মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসা করতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার মুখোমুখি হই তা হচ্ছে অর্থায়নের সমস্যা। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। সেই আগ্রহ থেকে সবকিছু মিলে যাওয়ায় ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ১৯৯৪ সাল থেকে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত। বর্তমানে ডিএসইতে এটি মাঝারি মানের ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি। সর্বশেষ গতকাল সোমবার কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৫ টাকা ৬০ পয়সা। এদিন বাজারে এটির শেয়ারের দাম সোয়া ১ শতাংশ বা ২০ পয়সা কমেছে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৮৭ কোটি টাকা, যা ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১৮ কোটি ৭১ লাখ শেয়ারে বিভক্ত।

অপর কোম্পানি ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্স ১৯৯০ সালে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এটি ভালো মৌলভিত্তির ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি। সর্বশেষ গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪১ টাকা ২০ পয়সা। এদিন বাজারে প্রতিটি শেয়ারের দাম প্রায় দুই টাকা বা সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন সাড়ে ৪৪ কোটি টাকা, যা ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৪ কোটি ৪৫ লাখ শেয়ারে বিভক্ত।