তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উচ্চ মূল্য সংযোজনে গুরুত্ব দিতে হবে: সেমিনারে অভিমত
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় নীতির অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে এখন উচ্চ মূল্য সংযোজনে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন বক্তারা। সেই সঙ্গে আইসিটি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে কার্যালয় স্থাপনের অনুমিত দেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত আজ ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা, সফটওয়্যার, যন্ত্রপাতিসহ তথ্যপ্রযুক্তির বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ কোটি ডলার। বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আয় ২৫০ কোটি ডলার, যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
ডিসিসিআই আয়োজিত সেমিনারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন। খবর বিজ্ঞপ্তি
সেমিনারের সূচনা বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ আরও বলেন, এ খাতে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চতর মূল্য সংযোজন পরিষেবার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সেমিকন্ডাক্টর ভ্যালু চেইনে উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া পণ্যের ডিজাইন, অ্যাসেম্বলি প্যাকেজিং, টেস্টিং (এপিটি) প্রভৃতি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উদীয়মান আইওটি বাজারের জন্য ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের (আইডিএম) সুযোগগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন, যথাযথ বাস্তবায়ন, কৌশলগত বিনিয়োগ, সরকারি ও বেসরকারি খাতসহ সব অংশীদারের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা জরুরি। তিনি আরও বলেন, সফটওয়্যার ও পরিষেবা রপ্তানি খাতে অনেক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রায় ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এ খাতে দক্ষতার ঘাটতি ও পরিকাঠামোর অভাবের কথা উল্লেখ করে আশরাফ আহমেদ বলেন, এই ব্যবধান মেটাতে শিক্ষা, লজিস্টিক পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ মূল্য সংযোজন তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার জন্য তিনি গবেষণা ও উন্নয়ন এবং রপ্তানি প্রণোদনার গুরুত্বে জোর দেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে, বিষয়টি সবার বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিদ্যমান নীতিমালাগুলো যথাযথ বাস্তবায়িত হলে নাগরিক সেবার পাশাপাশি ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজতর হবে। বর্তমান সরকার এ বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, রপ্তানি পরিসংখ্যানসহ অন্যান্য তথ্যে বেশ অসংগতি ছিল; এসব নিরসনে বর্তমান সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের পর তথ্যপ্রযুক্তি খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, যেখানে বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ সম্ভব। তিনি বলেন, দেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের অনুমতি প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণের লক্ষ্যে বিডার পক্ষ থেকে কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল কার্যক্রমের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, বিডার ফ্রন্ট অফিসে একজন রিলেশনশিপ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, যাঁর কাজ হবে, সিঙ্গেল ডেস্ক থেকে বিনিয়োগকারীদের দ্রুত সব পরিষেবা দেওয়া।
বন্ডস্টেইন টেকনোলোজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২ হাজার ৬০০টিরও বেশি আইটি কোম্পানি কাজ করছে।
এই খাতে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, এবং এই খাতের বাজারের আকার ২৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৪৫০টি বাংলাদেশি কোম্পানি নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে। সফটওয়্যার পরিষেবার সীমিত সুযোগের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিভাইস (যন্ত্র) উৎপাদনক্ষমতা নেই বলে জানান মীর শাহরুখ ইসলাম।
বাংলাদেশ থেকে আইটি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, রপ্তানি বাড়াতে তিনি স্থানীয় আইসিটি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া এবং আইসিটি পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেন মীর শাহরুখ ইসলাম। তিনি আরও বলেন, আইসিটি উদ্যোক্তারা সহায়ক নীতির অভাব এবং ঋণপ্রাপ্তিতে কঠোর জামানতের শর্তের মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই খাতের বিকাশে পণ্যের মেধাস্বত্ব অধিকারের সুরক্ষা জরুরি।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) মোহাম্মদ জাকির হাসান, বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেডের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা তাইমুর রহমান ও ওয়ালটন ডিজি টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লিয়াকত আলী অংশ নেন।
বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কর প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তিনি টেকসই ও সবুজ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধিতে জোরারোপ করেন। আলমাস কবির আরও বলেন, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ট্রান্সমিশন খরচ বৃদ্ধির কারণে এই খাতের সেবা পেতে জনগণের বেশি ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি টেলিযোগাযোগ নীতিমালা সংস্কারে জোর দেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক সার্বভৌম ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা যেতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তিনি মেধাস্বত্ব আইনের কার্যকর প্রয়োগের ওপর জোরারোপ করেন।
ঢাকা চেম্বারে ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী মুক্ত আলোচনা সঞ্চালনা করেন। সেখানে আলোচকেরা অপ্রতুল অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার অভাব, ঋণপ্রাপ্তিতে জটিলতা, দক্ষ জনবলের সংকট, সহায়ক কর ও শুল্ককাঠামোর অনুপস্থিতির কারণে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে মত দেন।
ডিসিসিআই সহসভাপতি মো. জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ সরকারি-বেসরকারি খাতের আমন্ত্রিত অতিথিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।