হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে তদারকি শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চালের আড়তে তদারকি করতে যাবে একটি দল— এমনটা জানিয়ে গতকাল বুধবারই গণমাধ্যমে বার্তা পাঠায় মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ঢাকার মালিবাগ, খিলগাঁও তালতলা বাজার ও ঠাটারীবাজারে এদিন অভিযান চালানো হয়েছে।
আজ বেলা ১১টা ১০ মিনিটে যাত্রাবাড়ী চালের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, তখনো মন্ত্রণালয়ের তদারকি দল আসেনি। সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী-কর্মচারীকে বলতে শোনা যায়, মোবাইল কোর্ট আসবে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় সোয়া ঘণ্টা পর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদারকি দল এসে পৌঁছায় যাত্রাবাড়ী চালের আড়তে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথমেই জনপ্রিয় রাইস এজেন্সি নামের প্রতিষ্ঠানে যান। প্রথমেই তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির টাঙানো তালিকার সঙ্গে চালের নমুনার মিল আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখেন। সব নমুনা চালের মধ্যে নাম ও দামসংবলিত কাগজ লাগানোর নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা।
এই আড়তে প্রতি কেজি আটাশ-১ জাতের চাল ৫৪ টাকা এবং আটাশ-২ চাল ৫১ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। তদারকি কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নুরুল হক জানান, প্রতি কেজি আটাশ-২ জাতের চাল ৪৯ টাকায় কেনা, বিক্রি করছেন ৫১ টাকায়। আর ৫০ টাকায় কেনা আটাশ-১ চাল ৫৪ টাকায় বিক্রি করছেন।
তখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রশ্ন করেন, পরিবহন ব্যয়, শ্রমিকের মজুরি ও মুনাফা যোগ করার পর আটাশ-২ চাল ক্রয়মূল্যের সঙ্গে আরও ২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করলেও আটাশ-১ চাল কেন কেজিতে ৪ টাকা বেশিতে বিক্রি করছেন? জবাবে আড়ত মালিক দাবি করেন, আটাশ-২ জাতের চাল দ্রুত বিক্রি হলেও আটাশ-১ চাল কম বিক্রি হয়। সে জন্য দাম কিছুটা বেশি।
কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির মালিককে আটাশ-১ চালের দাম কেজিতে ১ টাকা কমানোর নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে মূল্যতালিকায় ওই চালটির দাম ৫৪ টাকার পরিবর্তে ৫৩ টাকা লিখতে বলেন। আড়তটির একজন কর্মচারী সঙ্গে সঙ্গে তালিকাটি সংশোধন করেন।
এরপর তদারকি দল মা-মনি রাইস এজেন্সি, দিদার রাইস এজেন্সি, আহম্মেদ ট্রেডার্স—এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে মালিকপক্ষকে চালের মূল্য তালিকার পাশাপাশি নমুনার (চাল) নাম লিখে রাখার নির্দেশনা দেন কর্মকর্তারা। তাঁরা একাধিক প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র না পেয়ে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন।
তখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি দল দিদার রাইস এজেন্সিতে যায়। আড়তটির তালিকায় দেখা যায়, এরফান অটো রাইস মিলের মিনিকেট চাল ৬৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে এই প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে চাল কেনার চালান দেখতে চান কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার রবিউল হোসেন চালান বের করে দেখান। এতে দেখা যায়, ১৫ জানুয়ারি ৬৫ টাকা কেজি দরে চাল কেনা হয়েছে। ম্যানেজার জানান, সেদিন ২৮০ বস্তা চাল কিনতে ২২ হাজার ৫০০ টাকা ট্রাক ভাড়া এবং শ্রমিকদের ৩ হাজার ৮০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়েছে। তাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাল আনতে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালে খরচ পড়েছে ৯১ টাকা ৩৫ পয়সা।
তখন তাঁর আগের চালান দেখতে চান কর্মকর্তারা। ম্যানেজার তা দেখাতে গড়িমসি করেন। পরে কর্মকর্তারা বলেন, ১৫ জানুয়ারির আগের চালানের চাল যদি গুদামে পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর ম্যানেজার ড্রয়ার থেকে চালান বের করেন। তাতে দেখা যায়, চাল কেনা হয়েছে ৬১ টাকা কেজি দরে। তখন কর্মকর্তারা ম্যানেজারকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে মিনিকেট চালের দাম ৬৯ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ টাকা করতে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তালিকাও সংশোধন করার নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা। তাঁদের উপস্থিতিতে সেটি করেন দিদার রাইস এজেন্সির কর্মচারীরা।
জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের বাজার তদারকি করে আমরা বিশৃঙ্খলা পেয়েছি। কম দামে আগের কেনা চালও বাড়তি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। আজকে প্রথমবার তদারকি করে আমরা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছি। পরবর্তী সময়ে এসে অনিয়ম পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বেলা সোয়া একটার দিকে যাত্রাবাড়ী চালের আড়তে তদারকি শেষ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চলে যান। তাঁরা যখন চলে যান, তখন যাত্রাবাড়ী চাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মঞ্জুর আলম সাংবাদিকদের বলেন, চালের মোকামে আগুন। ফলে এখানেও দাম বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। মোকামে দাম কমলে এখানেও কমে যাবে।
এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আজ রাজধানীর মালিবাগ বাজারে অভিযানে চালায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল। বেলা ১১টার দিকে এই অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও তা শুরু হতে ১২টা বাজে। এরপর খালেক রাইস এজেন্সি, ফাহিম রাইস ও টাঙ্গাইল রাইস এজেন্সি নামে এই বাজারের মাত্র তিনটি দোকানে অভিযান চালানো হয়। তাদের কাগজপত্র ও দরদাম যাচাই–বাছাই করে অভিযানকারী দলের সদস্যরা আধা ঘণ্টার মধ্যে মালিবাগ বাজার ত্যাগ করেন।
এ সময়ে কোনো দোকানেই বড় ধরনের কোনো অসংগতি না পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের শুধু মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন অভিযানে আসা কর্মকর্তারা। তবে তাঁদের অভিযানে আসার আগেই ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। অভিযানের আগেই বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের দোকানের মূল্যতালিকা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব প্রস্তুত করে রাখতে দেখা যায়।
অভিযানকালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শ্রাবস্তী রায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দোকানের ব্যবসা সনদ যাচাই করেছি। ক্রয় রসিদ ও দোকানের মূল্যতালিকার মধ্যে দাম নিয়ে বড় কোনো তারতম্য আছে কি না, তা দেখেছি। সকল ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে যাচ্ছি। চালের বাজারে অস্থিরতা না কমা পর্যন্ত আমাদের এই অভিযান চলবে।’
অভিযান শেষে ফাহিম রাইসের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এখানে এসে অনেকক্ষণ ধরে সবকিছু দেখল। বড় কোনো ঝামেলা পায়নি। মূল্যতালিকায় বিক্রয়মূল্যের পাশাপাশি ক্রয়মূল্য লেখার জন্য বলে দিয়েছেন। আমি সেভাবে তালিকা ঠিক করে নিচ্ছি।’