হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন
বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে ২৬ শতাংশ। রপ্তানি আয়ও কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি ডলারে।
বিদায়ী অর্থবছরে ভারতের হিমায়িত বাগদা চিংড়ি রপ্তানি ৫৫ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়েছে। এতে দেশটির বাগদার রপ্তানি বেড়ে ৩২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমে গেছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তাতে চিংড়ির রপ্তানি ৪০ কোটি ৭২ লাখ ডলার থেকে কমে গত বছর ৩০ কোটি ডলারে নেমেছে।
বাংলাদেশের হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারকেরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাগদার চাহিদার পাশাপাশি দামও কমেছে। অন্যদিকে চিংড়ির উচ্চফলনশীল জাত ভেনামির চাষও পুরোপুরি শুরু হয়নি। বর্তমান বিভিন্ন দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির সিংহভাগই ভেনামি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ভারত কীভাবে বাগদার রপ্তানি বৃদ্ধি করল, বাংলাদেশ কেন পারল না—সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। তার আগে বলে নেওয়া ভালো, ভারতের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ৫০০ কোটি ডলারের বেশি। তার মধ্যে অধিকাংশটাই ভেনামি। যদিও গত অর্থবছর তাদের ভেনামি চিংড়ির রপ্তানি ৮ শতাংশ কমে ৪৮১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ভেনামিতে সফল হতে ভারতের ৫-১০ বছর সময় লেগেছে। ফলে আমাদেরও তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। ভেনামি চাষ সফল করতে চাষিদের মূলধনের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।আমিন উল্লাহ, সাবেক সভাপতি, হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি
বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। তারপর টানা সাত বছর পণ্যটির রপ্তানি কমেছে। করোনার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে চিংড়ির রপ্তানি আবার নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। যদিও পণ্যটি রপ্তানির জন্য সরকার বছরের পর বছর ধরে ১০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দিচ্ছে।
চিংড়ির বৈশ্বিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই সামান্য। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবসা–বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার ওইসি ওয়ার্ল্ডের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ২০৩ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ রপ্তানি করেছে ইকুয়েডর। তারপর ভারত সাড়ে ২৩, ভিয়েতনাম ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া পৌনে ৭ ও আর্জেন্টিনা ৫ শতাংশ রপ্তানি করেছে। ওই বছর বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানিতে হিস্যা ছিল দেড় শতাংশ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ইকুয়েডর সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করেছে। তারপর ভারত ৭ লাখ ৪ হাজার এবং ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি। আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ২৫ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ময়মনসিংহে চিংড়ি চাষ হয়। রপ্তানির জন্য ১০৮টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে নিয়মিত উৎপাদন করে ৩০-৩৫টি কারখানা। যদিও কাঁচামালের অভাবে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাতে পারছে না একটিও।
সমাধান কি তাহলে ভেনামি
দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি চেয়ে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দেনদরবার করেন রপ্তানিকারকেরা। তবে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে—এ যুক্তিতে শুরুতে ভেনামি চাষে উৎসাহ বা অনুমতি কোনোটাই দেয়নি মৎস্য অধিদপ্তর। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার পরীক্ষামূলকভাবে এই চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়। করোনার কারণে তা–ও পিছিয়ে যায়। ২০২১ সালে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত লোনাপানি গবেষণাকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হয়। পরে গত বছর আটটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চাষ করে।
পরীক্ষামূলক চাষ সফল হওয়ার পর চলতি বছর এই উচ্চফলনশীল জাতের চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এখন পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চাষের অনুমতি পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় খুলনার একটি প্রতিষ্ঠানকে ভেনামির পোনা উৎপাদনের পরীক্ষামূলক অনুমতিও দেয় মৎস্য অধিদপ্তর।
দুই দশক আগে থেকে দামে সস্তা হওয়ায় দুনিয়াজুড়ে ভেনামি চিংড়ির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এখন সারা বিশ্বে যে চিংড়ি রপ্তানি হয়, তার ৭৭ শতাংশই ভেনামি।
জানতে চাইলে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি আমিন উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেনামিতে সফল হতে ভারতের ৫-১০ বছর সময় লেগেছে। ফলে আমাদেরও তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। ভেনামি চাষ সফল করতে চাষিদের মূলধনের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, বর্তমানে বাগদা চাষে প্রতি একরে ১-২ লাখ টাকা লাগে। ভেনামি করতে হবে সেমি-ইনসেনটিভ পদ্ধতিতে। তাতে প্রতি একরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে।’
বাগদাও পিছিয়ে পড়ছে কেন
ভারতে পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়। উৎপাদন ৮ লাখ মেট্রিক টন। তার বিপরীতে বাংলাদেশে ২ লাখ ৬২ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়। উৎপাদন ১ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি। তার মানে বাংলাদেশ থেকে অনেক কম জমিতে চাষ করেও ভারতের উৎপাদন ছয় গুণের বেশি।
যশোরের এমইউ সি ফুডস সাড়ে তিন দশক ধরে হিমায়িত চিংড়ির ব্যবসা করছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ১০ লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। বিদায়ী বছর সেটি কিছুটা কমে ১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এমইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির সিংহভাগ ভেনামি। তারপরও দুই বছর ধরে গুজরাটে বাগদার চাষ বাড়ানো হয়েছে।
তাতে যেটি হয়েছে, তারা ২০ টন ভেনামির একটি কনটেইনারে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পাঁচ টন বাগদা দিতে পারছে। তারা বৈচিত্র্যময় পণ্যের কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি।’
শ্যামল দাশ আরও বলেন, ‘বাগদা রপ্তানিতে টিকতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। যুদ্ধের আগে এক পাউন্ড চিংড়ির (মাথাবিহীন ১৬-২০ পিস চিংড়ি) দাম ছিল ১৪ ডলার ৫০ সেন্ট। এখন ১১ ডলার ২০ সেন্টের বেশি মিলছে না। উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
তা ছাড়া ভারতের হ্যাচারিতে যেসব পোনা পাওয়া যায়, সেগুলোর স্বাস্থ্য ভালো, রোগবালাই কম। আমাদের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি মানসম্মত পোনার সরবরাহ নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’