তিন দিক থেকে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা
নানামুখী সংকটে এখন দেশের অর্থনীতি। এ সংকট যেমন সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যকে কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। শিল্পকারখানাগুলো এখন খাবি খাচ্ছে সংকট মোকাবিলায়। একদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমছে বিক্রি। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন উদ্যোক্তাদের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সংকট সামাল দিচ্ছে, কী ধরনের কৌশল নিচ্ছে এবং সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা কি—ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন শীর্ষপর্যায়ের পাঁচটি খাতের পাঁচজন উদ্যোক্তা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন সুজয় মহাজন, মাসুদ মিলাদ ও শুভংকর কর্মকার।
চলমান অর্থনৈতিক সংকটে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আকিজ গ্রুপ প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে বিভিন্ন বিপৎসংকুল অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।
আমরা তিন দিক থেকে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। প্রথমত, গ্যাস–সংকটের কারণে আমাদের সিরামিক কারখানার উৎপাদন কমেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমেছে ৫০-৬০ শতাংশ। তাদের তুলনায় আমরা কিছুটা ভালো আছি। কারণ, গত কয়েক বছরে কয়লা ও সৌরবিদ্যুতের মতো বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করেছি। তাতে অন্যদের চেয়ে আমাদের উৎপাদন ১০ শতাংশের মতো বেশি করতে পারছি। দ্বিতীয়ত, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের খরচ ২৫-৩০ শতাংশ বেড়েছে। আমরা ডলারে কিছু ঋণ করেছিলাম। সেই দায় মেটাতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। তৃতীয়ত, গ্যাস–সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ যতটা বেড়েছে, সে অনুযায়ী দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। তার প্রধান কারণ, উৎপাদন পর্যায়ের ভ্যাট নিয়ে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রয়েছে।
আকিজ গ্রুপের কর্মীদের মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ ১০-১২ কোটি টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকট চললেও মাসের ২ তারিখে আমরা তা নিয়মিতই পরিশোধ করছি। এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকঋণ বাড়ছে। তাতে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুর্বলতাও বাড়ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যতটুকু গ্যাস পাচ্ছি, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছি। এ জন্য আমাদের কারখানায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। এভাবেই আমরা গ্যাস বাঁচানোর চেষ্টা করছি। পাঁচ বছর ধরে আমাদের শিল্পকারখানাগুলোয় কমবেশি গ্যাসের সংকট আছে। চলতি বছর তা প্রকট আকার ধারণ করে। তবে গত কয়েক বছরে আমরা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থায় গিয়েছি। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
শিল্পকারখানার জন্য গ্যাস অনেকটা অক্সিজেনের মতোই কাজ করে। একজন স্বাভাবিক মানুষের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা থাকে ৯০-১০০ শতাংশ। সেটি যদি ৯০-এর নিচে নেমে যায়, তাহলেই রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। তেমনই শিল্পকারখানায় যদি ১০-২০ শতাংশ গ্যাস কম সরবরাহ করা হয়, তাহলে তা যেকোনো সময় আইসিইউতে যেতে বাধ্য।
বর্তমান গ্যাস–সংকট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার পার্শ্ববর্তী বা বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে জ্বালানি আমদানির চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেটি সফল না হওয়া পর্যন্ত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি শিল্পকারখানা কতটুকু গ্যাস দিতে পারবে, সেটি সুনির্দিষ্ট করে দিক। আর তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর আওতাধীন শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি সমিতি করা হোক। তারপর উদ্যোক্তারা চূড়ান্ত করুক কে কতটুকু গ্যাস ব্যবহার করবে। এমনটি হলে যে কারখানাগুলো ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে, সেগুলোর সক্ষমতা ৭৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কারণ, তখন অনেক উদ্যোক্তা গ্যাসের প্রাপ্তি অনুযায়ী কারখানার সক্ষমতা কমাবেন। এখন তো দুই ঘণ্টা পর গ্যাসের চাপ কী থাকবে, সে বিষয়ে আমরা অন্ধকারে থাকি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ডলারের ওপর চাপ কমে আসবে, যদি আমরা চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস করতে পারি। তাই সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের ঘাটতি কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। তাহলেই ডলার তার সঠিক অবস্থানে ফিরে আসবে।