দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক নয়, শেয়ারবাজারই শ্রেয়
ব্যাংক দেবে চলতি মূলধন, আর মূল অর্থায়ন হবে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে—এটাই বৈশ্বিক চর্চা। কিন্তু বাংলাদেশ রয়েছে ঠিক উল্টো পথে। আর বাংলাদেশের যখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে আর মাত্র বছর তিনেক বাকি, তখনো দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাঁদের প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ জোগাতে ব্যাংক খাতকেই বেছে নিচ্ছেন। এতে সমস্যা হচ্ছে দুই দিকেই। একদিকে ব্যাংক খাত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে গ্রহীতাদের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে পুঁজিবাজার অর্থায়নের ক্ষেত্রে অগভীর বা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
সচিবালয়ে গতকাল বুধবার ‘দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ও মূলধন বাজারের উন্নয়ন’ শীর্ষক এক বৈঠকে এসব কথা উঠে এসেছে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আনোয়ার হোসেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল ও যুগ্ম সচিব নাহিদ হোসেন, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব খালেদ হাসান ফয়সল, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নির্বাহী পরিচালক মো. হারুন-অর-রশীদ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) উপসচিব দীপক কুমার বিশ্বাস, বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সাদিয়া আফরিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ও মূলধন বাজারের উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি কর্মসূচি রয়েছে। ‘বাংলাদেশ: যৌথ পুঁজিবাজার উন্নয়ন কর্মসূচি’ শীর্ষক এ কর্মসূচির আওতায় গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইডিআরএ ও আইআরডিকে ১৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সময়সীমা এভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৩ মাস, ৩ মাস থেকে ১৮ মাস এবং ১৮ মাসের বেশি। গত ছয় মাসে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতির চিত্রও বৈঠকে আলোচনা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, ১৮টি সুপারিশের মধ্যে চারটি সম্পূর্ণভাবে এবং সাতটি আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাস্তবায়নের এমন চিত্রে হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। নতুন–পুরোনো মিলিয়ে এখন আবার সুপারিশ করা হয়েছে ২৪টি।
বৈঠকে উপস্থাপিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কার্যপত্রে বলা হয়, দেশের বিদ্যমান অবকাঠামো প্রকল্প এবং অন্যান্য খাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর। সংগত কারণেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর কম। এ কারণে অনেক অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাংকনির্ভর অর্থায়নের কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ও লাগে বেশি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতে, ব্যাংক খাতের পাশাপাশি পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণবাজার সৃষ্টি করতে হবে। সেই সঙ্গে এখন স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে বন্ড বাজারের উন্নয়নও দরকার। এতে অবকাঠামো, গৃহায়ণ ও শিল্পায়নে পুঁজির জোগান আসবে, যা ভূমিকা রাখবে কর্মসংস্থান তৈরিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য বলা হয়েছে, সুদের হারের সীমা তুলে নিতে হবে। ব্যাংক কোনো একক গ্রাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণ দিতে পারে না। কিন্তু বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এ নিয়ম ভেঙে ফেলে। এ চর্চা বন্ধ করতে হবে।
বৈঠক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে বেছে নিতে হবে, আর ব্যাংক খাত দেবে চলতি মূলধন—সে পথেই যেতে হবে আমাদের। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী দপ্তরগুলো যে যার কাজ করছে। এ পর্যায়ে আমরা সব দপ্তরকে একটি করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছি।’
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ বাস্তবায়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি রয়েছে। এখন আরও কয়েকটি উপকমিটি হবে। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সবাইকে এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে এবং দুই মাস পর আবার বৈঠক ডাকবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বৈঠকে বলা হয়, ব্যাংকঋণের সুদের সীমা ৯ শতাংশ থাকায় বেসরকারি বন্ড বাজারের উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বাজারের উপযোগী সরকারি-বেসরকারি বন্ড ছাড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্রও।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আস্থার সংকট রয়েছে। সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধিরাই এ কথা বলেছেন। আবার বন্ড ছাড়লেও বাজারে তা বিক্রি হবে না বলে আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। পাল্টা যুক্তিও এসেছে। তা হলো, বাজারে পণ্য থাকলে বিক্রি হবেই। বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সাদিয়া আফরিন বিষয়টিকে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ প্রবাদের সঙ্গে মিলিয়ে সমালোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক চলতি মূলধন দেবে আর পুঁজিবাজার দেবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন—এটাই স্বাভাবিক, এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দিক থেকে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নিচের পর্যায়ে বৈঠক বা সেমিনার করে কোনো লাভ হবে না। অবশ্যই এখানে দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের।’
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘যত কথাই বলি না কেন, ব্যাংকে যত দিন বাড়তি তারল্য থাকবে, তত দিন বেসরকারি খাত দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের কাছেই যাবে। এত শর্ত মেনে কে যাবে শেয়ারবাজারে?’
ব্যাংক চলতি মূলধন দেবে আর পুঁজিবাজার দেবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন—এ অবস্থা তৈরি হলে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার উভয় খাতের জন্যই মঙ্গলজনক হয়। ব্যাংক এখন শুধু দীর্ঘমেয়াদি ঋণই দিচ্ছে না, বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ঋণ পুনঃ তফসিলও করে দিচ্ছে। জনগণের আমানতের অর্থের নয়-ছয়সহ সুদ মওকুফের ঘটনাও কম নয়। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।