ঢাকায় এক পরিবারের খাবারে খরচ মাসে ২২ হাজার ৪২১ টাকা
মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়; দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ মানুষের খরচ কত বাড়িয়ে দিয়েছে, এর উদাহরণও দিয়েছে সিপিডি। যেমন মাছ-মাংস না খেয়েও ঢাকা শহরের চার সদস্যের এক পরিবারকে এখন খাবার কিনতে মাসে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি চলতি অক্টোবর মাসের হিসাব। গত পৌনে চার বছরে খাবার কেনায় ওই সব পরিবারের খাবার খরচ ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।
সিপিডির হিসাবে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা শহরের একটি পরিবার মাছ-মাংস খেলে খাবারে খরচ হতো ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা। আর মাছ-মাংস না খেলে এ খরচ ছিল ৬ হাজার ৫৪১ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতির চাপ বোঝাতে এ হিসাব দিয়েছে।
চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, লবণ, মাছ, মাংসসহ ১৯টি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কেনার গড় খরচ ধরে হিসাবটি করা হয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ আরবান সোশিও–ইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভেতে একজন মানুষ প্রতিদিন কী পরিমাণ খাবার গ্রহণ করে, তার ওপর ভিত্তি করে এ হিসাব করেছে সিপিডি। ১৬ অক্টোবরের বাজারদর বিবেচনায় আনা হয়েছে।
সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল ধানমন্ডির সিপিডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সিপিডি। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হচ্ছে। খাদ্যসংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, ভবিষ্যতে বিশ্বের ৪২টি দেশে খাদ্যসংকট হতে পারে। এ তালিকায় বাংলাদেশ আছে।
মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ভুগছে বলে মনে করে সিপিডি। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমল, এর বিশ্লেষণও দিয়েছে সিপিডি। তারা বলছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি আর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ছে।
সিপিডির মূল প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, এত কম হারে মজুরি বাড়লে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকেরা মাছ-মাংস না খেয়েও সংসার খরচ জোগাতে পারবেন না। তাঁদের ন্যূনতম মজুরি ৫ শতাংশ বাড়লেও তা সিপিডির হিসাব করা মাসিক গড় খাবার খরচের চেয়ে কম। এ তালিকায় আছেন তৈরি পোশাক; হোটেল-রেস্তোরাঁ, সাবান-প্রসাধনী, দরজি, বেকারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, প্লাস্টিক, চালকল, চামড়া ও পাদুকা খাতের শ্রমিকেরা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য একটি রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনায় সমস্যা তৈরি হতে পারে। কারণ, নিজের মজুত নিশ্চিত না করে কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করতে চাইবে না। তাই ডলার থাকলেও ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য পাওয়া না–ও যেতে পারে।
অর্থনীতিতে সাত সংকট
অর্থনীতিতে সাতটি সংকট আছে বলে মনে করে সিপিডি। এ সংকটগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য, জ্বালানিসংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এ সাত সংকট মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। কমিটি অর্থনীতির চলমান গতিপ্রবাহ তদারকিতে রাখবে; প্রয়োজনীয় নীতি তৈরি করবে এবং উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ কমিটিতে বেসরকারি খাতকেও সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সিপিডির মতে, অর্থনীতিতে চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো সঠিক, কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। উদ্যোগগুলো স্বল্পকালীন। এ বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘২০২৩ সালেও এ সংকট থেকে মুক্তি পাব না। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক বছরের মধ্যে পরিত্রাণ পাব, এটা আশা করা যায় না।’
খন্দকার মোয়াজ্জেমের মতে, বর্তমান সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে দারিদ্র্য বাড়তে পারে। কর্মসংস্থানের সংকট হতে পারে। এটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হতে পারে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ
সিপিডি বলেছে, আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী, ৬০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুত থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের পর্যাপ্ত মজুত নেই। অকটেন ২০ দিন, পেট্রল ৩৮ দিন এবং ফার্নেস তেল ২৮ দিনের মজুত আছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে টাকা যে নেই, তা নয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিপিসি মুনাফা করেছে।
সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশ করেছে সিপিডি। সিপিডি আরও বলেছে, ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু তারপরও লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। সিপিডি এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ বিষয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বড় খাত হলো ক্যাপাসিটি চার্জ। এখন সময় এসেছে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ নীতিতে যাওয়া। তাঁর মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু আমদানি করতে ডলার পাওয়া যাবে না। তাই ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করতে হবে।
সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থার গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ অন্য গবেষকেরা।