যে ৫ কারণে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে ধস নেমেছে
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি কম দিচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই প্রতিশ্রুতি অনেকটাই তলানিতে নেমে গেছে। প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সব মিলিয়ে ১৭৬ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। আগের বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪৭০ কোটি ডলার। সাধারণত প্রতিবছর গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা।
বিদেশি অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি কমে যাওয়ার পেছনে মোটাদাগে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে।
কোভিড-১৯
কোভিড-১৯ মহামারির সময় সারা বিশ্বেই মানুষের জীবনব্যবস্থা পাল্টে গিয়েছিল। কোভিডের সময় সীমিত ছিল চলাচল। ফলে বৈঠকগুলো প্রায়ই অনলাইনে হতো। কোভিড-১৯–এর কারণে প্রকল্প বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতিও কমেছে।
জানা গেছে, কোনো প্রকল্প পাস হওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে এক বছর আগেও কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেন। প্রকল্পে বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন হলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রধান কার্যালয় থেকে মিশন পাঠায়। তাঁরা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনসহ পুরো প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন করে থাকেন। এরপর উন্নয়ন সহযোগীর প্রধান কার্যালয় থেকে প্রস্তাবিত অর্থের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কিন্তু কোভিডের কারণে এই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর নিয়মিত মিশন বাংলাদেশে আসতে পারেনি। অনেক দিন স্থানীয় কার্যালয়ও বন্ধ ছিল। এ সময় বাসা থেকে অফিস করেন কর্মীরা।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে একটি বড় দাতা সংস্থার অবকাঠামো খাতের তিনটি প্রকল্পে প্রায় ৬০ কোটি ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কোভিডের সময়ের নানা ধরনের বাধাবিপত্তির প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে। তখন কম কাজ হয়েছে, তাই প্রতিশ্রুতি কম মিলেছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও বিদেশি সহায়তায় টান পড়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পড়েছে। ফলে এই যুদ্ধের প্রভাব যেসব দেশে বেশি পড়ছে, উন্নয়ন সহযোগীদের অনেকেই তাদের তহবিল সেসব দেশে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে।
এমনকি চীন ও ভারতের মতো যেসব উৎস থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সহায়তা পাওয়া যায়, সেসব উৎসও সীমিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে এই মুহূর্তে একটি প্রকল্প নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। ভারতের সঙ্গে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নিয়ে সহায়তা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
প্রকল্প নেওয়ায় ধীরগতি
বাংলাদেশে নতুন প্রকল্প নেওয়া কমেছে। এর শুরু কোভিড মহামারির সময় থেকে। তবে চলতি অর্থবছরেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মাত্র সাতটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোট প্রকল্প পাস হয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে মাত্র ৩১টি নতুন প্রকল্প। এর মধ্যে মাত্র ৯টি প্রকল্প বিদেশি সহায়তাপুষ্ট।
চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে একটি একনেক সভা হলেও অন্য বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩-৪টি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হতো। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এখন আগের চেয়ে অনেক কম প্রকল্প প্রস্তাব পাচ্ছে। যেহেতু সাধারণভাবেই প্রকল্প অনুমোদনের কার্যক্রম কমে গেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পও কমেছে।
পাল্টে গেছে সরকারের অগ্রাধিকার
সরকারের বিদেশি সহায়তার অগ্রাধিকারও পাল্টে গেছে। বিশেষ করে কোভিডের শুরুর সময় জরুরিভাবে বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে বাজেট সহায়তা পেয়েছিল। দুই বছর ধরে বাজেট সহায়তা নিচ্ছে সরকার। যেমন এডিবির কাছে এক শ কোটি ডলার পেয়েছে, আর ৪৭ কোটি ডলার পেয়েছে আইএমএফের কাছ থেকে।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ২৫ কোটি ডলার নিয়েছে। আগামী মাসে আরও ২৫ কোটি ডলার পাবে। এর বাইরে এডিবির কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাংক থেকে আরও ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন প্রকল্প সহায়তার চেয়ে বাজেট সহায়তায় বেশি আগ্রহী। কারণ, বাজেট সহায়তার জন্য কিছু শর্ত দেওয়া হলেও মাত্র এক-দুই মাসের দর-কষাকষিতে দ্রুত অর্থ ছাড় হয়। বাজেট সহায়তা সরকার যেখানে খুশি খরচ করতে পারে। এসব কারণেও প্রকল্পে উন্নয়ন সহায়তায় আগ্রহ কমেছে।
রাজস্ব আহরণ কম
কোনো প্রকল্পে বিদেশি সহায়তা থাকলেও খরচের একটি অংশ সরকারকে বহন করতে হয়। সরকার নিজস্ব উৎস থেকে আহরিত রাজস্ব থেকে সেই অর্থের জোগান দেয়। কিন্তু কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি এবং ডলার–সংকটের কারণে সরকারের অর্থ খরচের সামর্থ্য সীমিত হয়েছে।
প্রকল্পের নানা খাতে যেমন খরচ কমানো হচ্ছে, তেমনি জরুরি প্রয়োজন না হলে নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না।
সরকার রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তাতে এরই মধ্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায়ে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা।
কর্মকর্তারা যা বলছেন
বর্তমান বছরে বিদেশি সহায়তা কমে যাওয়ার বিষয়ে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেতে প্রকল্প পরিকল্পনা, প্রস্তাব প্রস্তুত করা, দর–কষাকষিসহ বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় এবং এগুলো শেষ করে চুক্তি হয়। এতে বেশ সময় লাগে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিশ্রুতির হিসাব বছরের মাঝের সময় ধরে করলে প্রকৃত হিসাব না-ও বোঝা যেতে পারে। দেখা যায় অর্থবছরের শেষ নাগাদ অনেক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।’