সামগ্রিকভাবে ব্যবসাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের আস্থা বাড়লেও উৎপাদনে ব্যবহার করা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিস ভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়তে থাকায় আগামী দিনগুলোতে তাঁদের কপালের ভাঁজ আরও চওড়া হতে পারে বলে মনে করছে ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) বলছে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে আগস্ট সময়ে করা এক জরিপে সামগ্রিকভাবে ব্যবসায় আস্থা পরিস্থিতির ইতিবাচক চিত্র দেখা গেলেও ব্যবসায়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা তৈরি পোশাক খাতের মতো বড় খাতকেও চাপে ফেলতে পারে। এই অবস্থায় ব্যবসার ব্যয় কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে পরামর্শ দিয়েছে বিল্ড।
আজ রোববার বিজনেস কনফিডেন্স সার্ভে রিপোর্ট ২০২২-২৩ বা ব্যবসার আস্থা সূচক নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। এটি ছিল এই বিষয়ে তাদের পঞ্চম প্রতিবেদন। এবারের প্রতিবেদনটি তৈরিতে অবশ্য গবেষণা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে বিল্ড।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জন্য সামগ্রিক বিজনেস কনফিডেন্স ইনডেক্স (বিসিআই) দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৪ পয়েন্ট। এই স্কোর চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ব্যবসা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করে বিল্ড। জুন মাসের শেষে এসে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার আস্থা সূচক ১০০ বেসিস পয়েন্টের মধ্যে ৭৮ দশমিক ২ পয়েন্ট স্কোর করতে পারে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।
মূল উপস্থাপনায় বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বিজনেস কনফিডেন্স সার্ভেতে ছয় মাসের (ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জুন ২০২৩) সময়কালের জন্য সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদন খাতকে বেশি ইতিবাচক বলে মনে করা হচ্ছে। সেবা খাতের স্কোর আগামী জুন মাসের শেষ নাগাদ হতে পারে ৭৫ দশমিক ৯ পয়েন্ট। সেই তুলনায় উৎপাদন খাতের স্কোর দাঁড়াতে পারে ৮০ পয়েন্ট।
তবে জরিপে দেখা যাচ্ছে, সেবা খাতের পরিচালন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা যেতে পারে বলে মনে করেন ফেরদৌস আরা বেগম। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদের তুলনায় নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় আস্থা কম পরিলক্ষিত হওয়ায় এ থেকে উত্তরণের জন্যও কাজ করতে হবে বলে জানান তিনি।
বিল্ড সিইও জানান, এ বছরের বিজনেস কনফিডেন্স জরিপে সাতটি বিষয়ের মধ্যে ছয়টিতেই উন্নতি দেখা গেছে। এ ছয়টি বিষয় হলো কর্মসংস্থান, ক্রয়াদেশ, সেবার চাহিদা, ব্যবসায় কার্যক্রম, বিক্রয়মূল্য ও বিনিয়োগ। শুধু ব্যবসায় ব্যয় সম্পর্কিত মতামতের ক্ষেত্রে নেতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।
জরিপ বলছে, ব্যবসাসংক্রান্ত মতামতের ক্ষেত্রে সামগ্রিক সূচক দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্যবসা পরিচালনার বিভিন্ন ব্যয় বাড়তে থাকায় চলতি বছরের জুনের শেষ নাগাদ এই সূচক দাঁড়াতে পারে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে। ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তৈরি পোশাক খাতে ব্যয়সংক্রান্ত এই সূচক এখনই দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩ পয়েন্টে, যা এই জরিপের সর্বনিম্ন স্কোর।
বিল্ড বলছে, গবেষণায় আস্থা সূচকের মধ্যবিন্দু ধরা হয়েছে ৫০ স্কোরকে। প্রাপ্ত ফলাফল ৫০-এর কম হলে সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই হিসাবে তৈরি পোশাক খাতের ব্যয়সংক্রান্ত স্কোর খুবই নাজুক অবস্থায় আছে বলে মনে করছে বিল্ড। এই অবস্থায় ব্যবসায় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বাড়বে এবং মুনাফা কমে আসবে। তবে বাকি ছয়টি বিষয়ে সামগ্রিক স্কোর ভালো থাকায় এই একটি বিষয় সামাল দিতে পারলে ব্যবসা ভালো হবে বলে মনে করে বিল্ড।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এই বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে আগামী ছয় মাসে উৎপাদন খাতের ক্রয়াদেশ, সেবা খাতে চাহিদা, বিক্রয়মূল্য ও ব্যবসায় কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। যদিও ‘ব্যয়’ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে উৎপাদন খাতের ব্যবসায়ীরা ‘নিম্ন আস্থা’ প্রকাশ করেছেন।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিস ভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘বাংলাদেশ সব ধরনের সংকট কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ। বিল্ডের এই প্রতিবেদন আমাদের সামনের দিনের পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।’ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা গেলে ভবিষ্যতে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।
বিল্ডের গবেষণার জন্য ৫৬৭ জন উদ্যোক্তার মতামত গ্রহণ করা হয়। এটি পরিচালনা করা হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর সময়কালে। এ জরিপ পরিচালনার উদ্দেশ্য ছিল ২০২২ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবসা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করা এবং জরিপ–পরবর্তী ছয় মাসের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। বিল্ড মনে করে, এর ফলে উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি প্রশমনের প্রস্তুতি নেওয়ার ও পরিকল্পনা করার সক্ষমতা বাড়ে।
বিল্ড ও ইউএসএআইডির অর্থায়নে ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যাকটিভিটির যৌথ উদ্যোগে এই জরিপ করা হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিল্ডের লজিস্টিকস ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কিং কমিটির কো-চেয়ার আবুল কাসেম খান, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল অঞ্চলের কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টম্যান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য মহসিনা ইয়াসমীন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ ফয়েজুল আমীন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সামির সাত্তার।