বন্যার ক্ষতি পোষানোর আগেই সিলেটের পর্যটন–বাণিজ্যে বিপর্যয়  

১৭ জুলাই থেকে সিলেটের হোটেল–মোটেল, রিসোর্ট ফাঁকা হয়ে যায়। অনেক হোটেল–রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানকর্মীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো।ফাইল ছবি

সিলেটে গত দুই মাসের ব্যবধানে তিন দফা বন্যার ক্ষতির ধাক্কা কাটানোর আগেই আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সৃষ্ট সংঘাতে পর্যটকহীন হয়ে পড়েছে সিলেট। অথচ এই বর্ষা মৌসুমেই সিলেটে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভিড় করেন।

সিলেটের পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে সিলেট। গত ১৭ জুলাই থেকে সিলেটের প্রায় প্রতিটি হোটেল–মোটেল, রিসোর্ট ফাঁকা হয়ে যায়। এ সময় অনেক হোটেল–রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কর্মীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো পর্যটক আসার সম্ভাবনা দেখছেন না এই খাতের ব্যবসায়ীরা। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পর্যটকশূন্যতায় বিপুল আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছেন এসব ব্যবসায়ী।

নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার হোটেল গোল্ডেন সিটির ব্যবস্থাপক মিন্টু দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দফা বন্যার ক্ষতির রেশ কাটতে না কাটতেই পর্যটন ব্যবসা আরেক দফা বিপর্যয়ের মুখে পড়ল।

এবার পর্যটনের ভরা এই মৌসুমে বৃষ্টি ও বন্যায় কয়েক দফায় পর্যটকখরা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। তাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত।
তাহমিন আহমেদ, সভাপতি, সিলেট চেম্বার 

সিলেটে ধর্মীয় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেন্দ্রিক দুই ধরনের পর্যটন–বাণিজ্য রয়েছে। ধর্মীয় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে নগরীর শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.)–এর মাজার এবং জেলার গোপালগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত চৈতন্য মহাপ্রভুর পৈতৃক ভিটা। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেন্দ্রিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর, গোয়াইনঘাটের জাফলং, রাতারগুল, মায়াবী ঝরনা, বিছনাকান্দি ও পান্তুমাই, জৈন্তাপুরের লালাখাল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেট ও মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, মৌলভীবাজারের টিলা ও চা–বাগান, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হবিগঞ্জের রেমা–কালেঙ্গা ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র। এসব পর্যটনকেন্দ্র দেশি–বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। এসব পর্যটনকেন্দ্রকে ঘিরে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে প্রাকৃতিক পরিবেশে শতাধিক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।

খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিলেট বিভাগের চার জেলার সব পর্যটনকেন্দ্র বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত পর্যটন খাত যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন নতুন এ ধাক্কা খাতটিকে আবারও ক্ষতির মুখে ফেলেছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বেগ পেতে হবে। 

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ায় সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় পর্যটনকেন্দ্রিক কয়েক হাজার নৌশ্রমিকের হাতে এখন কোনো কাজ নেই। এতে তাঁরা আয়রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন। একই কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। মণিপুরি পোশাক, চা–পাতা, সাতকরা, আচারসহ স্থানীয় পণ্যের দোকানগুলো বন্ধ আছে। সেই সঙ্গে পর্যটন–সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁ ও পরিবহন ব্যবসাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি সিলেট শহরতলির লাক্কাতুরা ও মালনীছড়া চা–বাগানে গিয়ে দেখা যায়, কোথাও কোনো মানুষ নেই। এই এলাকার আশপাশের বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এ দুটো স্থানে দিনভর পর্যটকদের ভিড় থাকত। ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ পর্যটক সিলেট অঞ্চলেরবিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আসেন ১২ থেকে ১৩ লাখ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে ৫ থেকে ১০ লাখ এবং হবিগঞ্জে ২ লাখ পর্যটক।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্র ও পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যবসা এক দিন বন্ধ থাকলে তিন–চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। সেই হিসাবে গত প্রায় ১০ দিনে এ অঞ্চলের পর্যটন ব্যবসার ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বৃহত্তর সিলেটে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষা মৌসুম। এবার পর্যটনের ভরা এই মৌসুমে বৃষ্টি ও বন্যায় কয়েক দফায় পর্যটকখরা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। তাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত।