ইলন মাস্ক বনাম মার্ক জাকারবার্গ, কে এগিয়ে কে পিছিয়ে
ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ও টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের মধ্যকার প্রতিযোগিতা পেশ পুরোনো। যখন প্রশ্ন ওঠে, এই দুজনের মধ্যে কে বেশি চিত্তাকর্ষক, তখন স্বাভাবিকভাবেই মাস্কের নামই এসে যায়।
জাকারবার্গ ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর মনটাও উদ্ভাবনী। অনেকেই তাঁকে হুডি পরা শৌখিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আখ্যা দেন, এতে অবশ্য তাঁর দক্ষতা ও জ্ঞানের বিষয়টি আড়ালে চলে যায়। ইলন মাস্ক টেসলাকে বিশ্বের শীর্ষ বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি এবং স্পেস এক্সকে বিশ্বের তারকা রকেট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে যে খ্যাতি ও প্রশংসার ভাগীদার হয়েছেন, জাকারবার্গ কখনোই তা পাননি।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্ক জাকারবার্গের মূলমন্ত্র হলো দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে সবকিছু ভেঙে ফেলো, এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ফেসবুকের পক্ষে হয়তো পৃথিবী জয় করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ফেসবুক একই সঙ্গে সামাজিক হুমকি হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। অথচ ইলন মাস্ক নিয়ম ভঙ্গকারী হিসেবে শ্রদ্ধার পাত্র; নিজের খারাপ ছেলের ভাবমূর্তি তিনি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন এবং এমনকি পারও পেয়ে যান।
ঠিক এ রকম প্রেক্ষাপটে গত বছরের জুন মাসে মার্ক জাকারবার্গকে বদ্ধ খাঁচায় দ্বৈরথ লড়ার আহ্বান জানান ইলন মাস্ক। তখন মেটা মাস্কের মালিকানাধীন টুইটারের মতো শর্ট মেসেজিং অ্যাপ থ্রেডস বাজারে নিয়ে আসে। শারীরিক লড়াই তাঁদের কখনোই হয়নি, কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে দেখা যায়, মাস্ক জাকারবার্গের ওপরেই ছিলেন।
মাস্ক একসময় বিশ্বের শীর্ষ ধনী ছিলেন। অন্যদিকে টেসলার বাজার মূল্য ইদানীং কমলেও মেটার চেয়ে বেশি এবং তার রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হারও মেটার চেয়ে বেশি ছিল। গত কয়েক বছরে টেসলার কর্মকাণ্ড বিনিয়োগকারীদের জন্য রীতিমতো ভীতিকর হয়ে উঠেছিল। ইলন মাস্ক একসময় বছরে ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বেতন–ভাতা পেয়েছেন। আদালত তাঁর এই বেতন–ভাতা বাতিল করেছে। ফলে মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদ কমে গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন সবখানেই তার বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, এমনকি বাজার থেকে তুলেও নিতে হয়েছে।
এর বিপরীতে মার্ক জাকারবার্গের সময় বেশ ভালো যাচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে মেটার আয়ের পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে মেটার বিক্রয় ও মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে। মেটার বাজার মূলধন ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সালে টেসলার বাজার মূলধন এই পর্যায়ে উঠেছিল।
তবে স্বল্পমেয়াদি আর্থিক পরিসংখ্যান দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না, দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ও দেখতে হয়। যেমন জাকারবার্গ যেভাবে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করছেন, শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করছেন বা ক্রেতাদের সামলাচ্ছেন বা নিজেদের ব্যর্থতা মোকাবিলা করছেন, সেখান থেকে পরিষ্কারভাবেই দেখা যায়, তিনি যুদ্ধে জিতে গেছেন।
এর কারণ বুঝতে এই দুই অতি ধনী কীভাবে তাঁদের সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন, সেদিকে নজর দিতে হবে। তাঁরা উভয়েই যে পদ্ধতিতে নিজের কোম্পানিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, তা করপোরেট সুশাসনপন্থীদের চোখে মোটেও ভালো কিছু নয়। মেটায় যে দ্বৈত শেয়ার কাঠামো আছে তার বদৌলতে মেটার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ এখন জাকারবার্গের হাতে। অন্যদিকে ইলন মাস্ক কার্যত কোম্পানির কর্মীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। জাকারবার্গ অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারের বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল হলেও মাস্ক অতটা নন। এতে তাঁদের কর্মসম্পাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
মার্ক জাকারবার্গের মনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে ২০২২ সাল থেকে। তখন তিনি মেটাভার্সের মতো প্রকল্পে অর্থ ওড়াচ্ছেন বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন। মেটার মূল ব্যবসা মার খাচ্ছিল। কিন্তু জাকারবার্গ তাদের কথা ফেলে দেননি। এরপর তিনি কোম্পানির ব্যয় সাশ্রয় করে মুনাফা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন। বিনিয়োগযোগ্য অর্থ তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো খাতে বিনিয়োগ করেন। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের অর্থ যে নষ্ট করা হচ্ছে না, তা বোঝাতে মেটা পুনরায় শেয়ার ক্রয় করে বিনিয়োগকারীদের হাতে অর্থ ফিরিয়ে দেয় এবং প্রথমবারের মতো বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও দেবে বলে ঘোষণা দেয়।
কিন্তু ইলন মাস্কের বিষয়টি সে রকম নয়। গত দুই বছরে টেসলার শেয়ারমূল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার পর মনে হচ্ছে, কোম্পানিটি যেন শেয়ারহোল্ডারদের হতাশ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। টেসলা এখন দামি গাড়ি ছাড় দিয়ে বিক্রি করছে। বিনিয়োগকারীরা চান, ইলন মাস্ক টেসলায় আরও বেশি সময় দিন। কিন্তু ইলন মাস্ক নিজের সময় টেসলা ও স্পেস এক্সের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন। সবাই যখন এআই ও রোবোটিকসে জোর দিচ্ছে, তখন ইলন মাস্ক উল্টো বলেছেন, টেসলায় তাঁকে ২৫ শতাংশ ভোটের ক্ষমতা দেওয়া না হলে তিনি টেসলা থেকে এআই ও রোবোটিকস সরিয়ে নেবেন।
মার্ক জাকারবার্গ বয়সের সঙ্গে আরও পরিপক্ব হচ্ছেন, কিন্তু ইলন মাস্ক বয়সের সঙ্গে আরও খ্যাপাটে হয়ে উঠছেন। এখানেই দুজনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।