ডলারের ‘দামের আঁচ’ ডিম-মুরগির বাজারে

ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। উপকরণ আমদানিও কমে গেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

মুরগির মাংস সাধারণ মানুষের নাগালের আরও বাইরে চলে গেল। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে এখন লাগছে ২১০-২২০ টাকা, যা জানুয়ারি মাসের শুরুতেও ১৫০ টাকার আশপাশে ছিল। এই সপ্তাহে নতুন করে দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা।

মুরগির সঙ্গে আরও বেড়েছে ডিমের দাম। গরুর মাংসের দামও বেড়েছে। খাসির মাংস আগে থেকেই স্বল্প আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আরও পড়ুন

ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ার দুটি কারণ বলছেন ব্যবসায়ীরা—এক. মার্কিন ডলারের দামের কারণে পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি। দুই. চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে কম সরবরাহ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যের চড়া দামের কারণে লোকসান দিয়ে ছোট অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে উৎপাদন এখন কম।

ডলারের অভাবে আমদানি করতে না পারায় বাজারে পোলট্রি খাদ্যের উপকরণের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আমদানি না বাড়লে এ খাতে সংকট আরও বাড়বে।
খন্দকার মো. মহসিন, সাধারণ সম্পাদক, পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ

ব্যবসায়ীদের এই দাবির সঙ্গে একমত নন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছোট খামারের মালিকেরা সাময়িকভাবে মুরগি পালন বন্ধ রাখতে পারেন। তবে বাস্তবতা হলো, চাহিদা অনুসারে মুরগির মাংস উৎপাদিত হচ্ছে। বাজারে মুরগির দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ নেই। মন্ত্রী মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে হচ্ছে না। মুনাফালোভী কেউ যেন বেশি দামে মুরগি বেচাকেনা করতে না পারেন, সে জন্য বাজারে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

দাম কত

কারণ যেটিই হোক, স্বল্প আয়ের মানুষ চড়া দামের কারণে প্রাণিজ আমিষের ‘সবচেয়ে সস্তা’ উৎসের নাগাল পাচ্ছে না। ব্রয়লার মুরগি সাধারণত প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। আর ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম বিক্রি হয় প্রতি ডজন ১০০ টাকার আশপাশে। এই দুটি পণ্যের দাম প্রাণিজ আমিষের অন্যান্য উৎসের চেয়ে কম।

কিন্তু এখনকার দাম আগের তুলনায় অনেক বেশি। গতকাল মঙ্গলবার দেখা যায়, কারওয়ান বাজারের মতো বড় বাজারে ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১৪০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা। আর পাড়ার খুচরা দোকানে তা ১৫০ টাকা রাখা হচ্ছে। জানুয়ারির শুরুতে মুরগির ডিম প্রতি ডজন ১২০ টাকায় বিক্রি হতো। হাঁসের ডিমের ডজন উঠেছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়, যা আগের চেয়ে ২০ টাকা বেশি।

ব্রয়লার মুরগি ছাড়াও সোনালি মুরগির দামও বাড়তি—প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়, যা গত জানুয়ারিতে ২৭০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো।

গরুর মাংসের দর প্রতি কেজি এখন ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা। দুই সপ্তাহে দর ২০ টাকা বেড়েছে। খাসির মাংসের দাম প্রতি কেজি ১ হাজার ১০০ টাকা। ছাগলের মাংস পাওয়া যায় ১ হাজার টাকা কেজিতে।

হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি কেন

মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় পোলট্রি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সামাজিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। এতে চাহিদা বেড়ে যায়। এ বছর চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম। ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের এই দাম কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, সেই ধারণা দিতে পারেননি তিনি।

মূল্যবৃদ্ধির জন্য বড় খামারি মালিকদের দায়ী করছেন ক্ষুদ্র অনেক খামারি। ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, দেশে মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তারাই দাম বাড়িয়ে রেখেছে।

খাদ্যের দাম ২০% বেড়েছে

পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে ভুট্টা, সয়ামিলসহ বিভিন্ন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। খাদ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ডলারের দামের কারণে আমদানির খরচ বেড়েছে। আরেকটি সমস্যা হলো, ব্যাংকগুলোতে ডলার–সংকট থাকায় আমদানির ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত মে মাসে দেশে মার্কিন ডলার ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন তা ১০৬ টাকা পড়ছে।

মুরগির খাবার উৎপাদনকারী প্রভিটা গ্রুপের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, তিন-চার মাসে পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। আর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের মতো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগির এক কেজি খাদ্যের দাম এখন ৬৮ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে। মাস তিনেক আগেও তা ৬০ থেকে ৬২ টাকা ছিল। বছর খানেক আগে ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা।

পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের অভাবে আমদানি করতে না পারায় বাজারে পোলট্রি খাদ্যের উপকরণের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আমদানি না বাড়লে এ খাতে সংকট আরও বাড়বে।

চাল, ডাল, তেল, চিনি, দুধ, সাবান, টুথপেস্টসহ নিত্যপণ্যের চড়া দামের মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষ নানাভাবে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মাংস খাওয়া তো একপ্রকার ভুলেই গেছি। মাছের দামও বাড়তি। একমাত্র ভরসা ছিল ব্রয়লার মুরগি, সেটাও এখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’