দেশে ব্যবসায় মূল বাধা দুর্নীতি

আগামী দুই বছরের জন্য মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির মূল ঝুঁকি হিসেবে অভিহিত করেছেন দেশের ৬৬ শতাংশ ব্যবসায়ী।

ব্যবসার পরিবেশ সংস্কার বিষয়ে সিপিডি আয়োজিত সংলাপে উপস্থিত অতিথিরা। গতকাল রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইনেছবি: প্রথম আলো

দেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। চলতি বছরও প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহার, নীতি পরিবর্তনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। গত এপ্রিল-জুলাইয়ে করা এই জরিপে সেবা, উৎপাদন ও অনুৎপাদন, কৃষিসহ অন্যান্য খাতের খাতের ৭৪ জন ব্যবসায়ী অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ আগামী দুই বছরের জন্য মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির মূল ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ছাড়া ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে অস্বাভাবিক আবহাওয়া, দূষণ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্য।

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। তবে সংস্কার করতে হবে অগ্রাধিকার তালিকার ভিত্তিতে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনার পর সেই বিনিয়োগের পরিচর্যা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
জাভেদ আখতার, সভাপতি, ফিকি

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল রোববার ‘বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশের সংস্কার: অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এজেন্ডা’ শীর্ষ সংলাপে এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, গত দেড় দশকে নিয়োগ ও ছাঁটাইব্যবস্থা, বেতন ও উৎপাদন ক্ষমতা, বিচারালয়ে ঘুষ, উদ্ভাবনী কোম্পানির প্রবৃদ্ধি, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প—এসব সূচকে অবনতি হয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী পরিচালক আশিক চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার প্রমুখ।

ব্যবসার পরিবেশ সংস্কার বিষয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা অনুসন্ধান ও সমাধানের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংস্কার কমিশন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনার জন্য বিজনেস ফোরাম করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়ে ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকার কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনা, সরকারের সব সেবাকে ডিজিটাল করার ওপর জোর দেন তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭ ধরনের বাধা চিহ্নিত হয়েছে। এসব বাধা দূর করতে হলে পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য কমিশন করা হয়েছে। ব্যবসার জন্য আলাদা কোনো কমিশন দরকার আছে কি? ব্যবসায়ীরা যদি বলেন, তাহলে আরেকটি কমিশন হতে পারে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ আসা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) অর্ধেকই পুনর্বিনিয়োগ। প্রকৃতি এফডিআই খুবই কম। সাম্প্রতিক সময়ে এফডিআই আসার হার নিম্নমুখী। ফলে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত নীতিসহায়তা অপরিবর্তিত রাখার চিন্তাভাবনা চলছে।’

বিদায়ী সরকার ১০৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এ বিষয়ে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা অর্থহীন। আমরা সরকারিভাবে ১০টির কম, সুনির্দিষ্ট করে বললে ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সংস্কার নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সবাই সংস্কারের কথা বলছে। তবে কে করবে। অন্তর্বর্তী সরকার? সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে পুরোপুরি সংস্কার করা যায় না। প্রথমেই রাজনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংলাপে দুর্বল ব্যাংক বন্ধ করার বিষয়টি উঠলেও সেটির তীব্র বিরোধিতা করে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘আমি নির্বিচার ব্যাংক বন্ধের ধারণার সঙ্গে একমত নই। ব্যাংকিং খাতে কেউ দুর্নীতি করলে তার শাস্তি হওয়া উচিত। তবে আমরা বলতে পারি না যে সব ব্যাংক বন্ধ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বৈরাচারী চর্চা করছে। এ চর্চার অবসান ঘটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুনর্গঠন করা দরকার।

ব্যবসায়ীরা যা বললেন

ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, অবকাঠামোর রাতারাতি উন্নতি হবে না। তবে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। তবে সংস্কার করতে হবে অগ্রাধিকার তালিকার ভিত্তিতে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনার পর সেই বিনিয়োগের পরিচর্যা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে সব সমস্যার মূল সমস্যা দুর্নীতি। ভ্যাট-ট্যাক্স অফিসেই বছরে ২৫-৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় আমাদের। সেটা আবার করনীতিতে দেখানো যায় না। সে জন্য ঘুষের টাকার ওপর আবার কর দিতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংস্কার শুরু করা দরকার। বৃত্তের বাইরে চিন্তা করতে হবে। নতুন করে কর, ভ্যাট ও কাস্টমসকে সাজাতে হবে। এটা করা গেলে ৫০ শতাংশ দুর্নীতি কমানো যায়।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, দুর্নীতি বড় সমস্যা। সরকারি সেবা অটোমেটেড করাই হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। ব্যাংক থেকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কঠিন। তাঁদের নথিপত্রেও দুর্বলতা আছে। এমন প্রেক্ষাপটে এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার কাজে লাগানো যায়।

বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। ব্যবসাভেদে ১৭০ ধরনের নথিপত্র লাগে বাংলাদেশে। কম্বোডিয়ায় ২৩, ইন্দোনেশিয়ায় ২০ ও ভিয়েতনামে ২১ ধরনের নথিপত্র প্রয়োজন হয় বলে জানান পিকার্ড বাংলাদেশের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অমৃতা মাকিন ইসলাম। তিনি বলেন, বন্দরের অদক্ষতায় কাঁচামাল আমদানিতে সময় বেশি লাগছে। এতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ৩০-৪০ বছর ধরে সংস্কার করা হচ্ছে। লোকদেখানো সংস্কার হয়েছে। তবে কার্যকর সংস্কার দরকার। তিনি বলেন, ব্যবসার খরচের চেয়ে ব্যবসা প্রবেশের খরচ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।