শেয়ারের 'ঠিকুজি' ছাড়া কালোটাকা সাদা নয়
শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করতে হলে শেয়ারের ‘ঠিকুজি’র হিসাব দিতে হবে। কালোটাকার মালিকেরা অতীতে কোন কোন কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন, এখন কোন কোম্পানির শেয়ার আছে—এসব হিসাব দিতে হবে। অতীত-বর্তমানের শেয়ারের যাবতীয় খতিয়ান ছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করা যাবে না।
চলতি অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার জন্য আলাদা ফরম ছাপিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেই ফরমে কালোটাকা সাদা করার বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি শেয়ারের অতীত ও বর্তমান খতিয়ান তুলে ধরতে হবে। এর মানে, কালোটাকার মালিকেরা কবে থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন, কবে কোন কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন, এখন কোন কোন কোম্পানির শেয়ার আছে, এই পর্যন্ত কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন—এসব তথ্য দিতে হবে। ওই ফরমে ১২ নম্বর ঘরে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের নম্বর, লেজার ও পোর্টফলিও স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়েছে।
কালোটাকা সাদা করার ফরমে কালোটাকা সাদাকারীর নাম, ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের নাম, কত টাকা সাদা করা হবে, করের পরিমাণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মোবাইল নম্বর—এসব তথ্য দিতে হবে। এই ফরম পূরণ করে ওই করদাতা যে অঞ্চলের করদাতা, সেই কর অঞ্চলে জমা দিতে হবে। এটিই কালোটাকা সাদা করার ঘোষণাপত্র হিসেবে গণ্য হবে। কালোটাকায় শেয়ার কেনার ৩০ দিনের মধ্যে এই ঘোষণা দিতে হবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমনকি নগদ টাকাও সাদা করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু ১০ শতাংশ কর দিলেই বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে এনবিআর। টাকার উৎস কী, তা–ও জানতে চাইবেন না কর কর্মকর্তারা।
গত ১১ জুন বাজেটে ঘোষণায় বলা হয়েছিল, কালোটাকায় যেসব কোম্পানির শেয়ার কেনা হবে, তা অন্তত তিন বছর বিক্রি করা যাবে না। এই শেয়ার ‘লক ইন’ থাকবে তিন বছর। পরে বাজেট পাসের সময় লক ইনের শর্ত কমিয়ে এক বছর করা হয়। যেদিন কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন, সেই দিন থেকে এক বছর শেয়ার লক ইন থাকবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালোটাকার মালিকদের শেয়ারবাজারের যাবতীয় তথ্য জানতে চাই। এতে তাঁদের শেয়ারে বিনিয়োগের পরিমাণ, জীবনযাত্রা, সামাজিক অবস্থান—এসব তথ্য জানা যাবে। তাঁদের সম্পদের বিবরণীও জানা যাবে।’
এর আগেও কয়েকবার বিনা শর্তে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোবারই তেমন একটা সাড়া পায়নি। যেমন, ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে মাত্র ৮২ জন ৩৮২ কোটি টাকা সাদা করেছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাত্র ৭০ জন শেয়ার কিনে কালোটাকা সাদা করেছিলেন। ওই বছর সব মিলিয়ে ১৩০ কোটি টাকা সাদা হয়েছিল।
শেয়ারবাজার চাঙা করার জন্য মূলত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কালোটাকা দিয়ে শেয়ারবাজার চাঙা করা যাবে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব চোরাই মাল (কালোটাকা) দিয়ে শেয়ারবাজার চাঙা করতে পারবে না সরকার। এসব ভেলকিবাজি নীতি দিয়ে কাজ হবে না।’
আহসান এইচ মনসুরের মতে, শেয়ারবাজারের গুণগত পরিবর্তন করতে হবে। ফাটকাবাজি বন্ধ করতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ার আনতে হবে। এসব করতে পারলেই শেয়ারবাজার চাঙা থাকবে।
এবার শেয়ারবাজার ছাড়াও ফ্ল্যাট, জমি কেনাসহ বিভিন্ন খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় সব সরকারের আমলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ভালো সাড়া মেলেনি। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে উপার্জিত সব মিলিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময়ে ৩২ হাজার ৫৫৮ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়।