শেয়ারবাজার থেকে বোকারামেরা দূরে থাকুক
বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারী নিয়ে ‘গ্রেটার ফুল থিওরি’ বলতে একটি কথা আছে। দুই অর্থনীতিবিদ আবদুল বায়েস ও মাহবুব হোসেন তাঁদের বইতে এর বাংলা করেছেন বোকারাম তত্ত্ব। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে বুদবুদ সুষ্টির পেছনে কাজ করে এক ধরনের উচ্চাভিলাষী বোকা খেলোয়াড়, যারা তাদের চেয়েও বড় বোকাদের কাছে বিক্রি করার প্রত্যাশায় আরও বেশি দামে শেয়ার কেনে।
দেশভাগ হয়ে গেছে। চলে গেল আরও পাঁচ বছর। ১৯৫২ সালে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ পাকিস্তানি কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। এরও দুই বছর পরে ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়। ১৯৬২ সালের ২৩ জুন এর নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড রাখা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৪ মে আবার নাম পরিবর্তন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি. (ডিএসই) রাখা হয়।
১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিক লেনদেন শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে, ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ নারায়ণগঞ্জ চেম্বার বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত হয়। ডিএসই ১৯৫৯ সালে ৯/এফ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় নিজস্ব ভবনে চলে আসে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ডিএসই নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৯৬, আর পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০০ কোটি রূপী। এ সময় ডিএসইতে প্রতিদিন ২০ হাজার শেয়ার লেনদেন হতো।
স্বাধীনতা লাভের পর সরকার জাতীয়করণ নীতি নেয়। ফলে ডিএসইর কার্যক্রম ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ১৯৭৫ এর পর সরকার জাতীয়করণ নীতি থেকে সরে আসে। এরপরই ১৯৭৬ সালে মাত্র ৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ডিএসই। তবে শেয়ারবাজার আলোচনায় আসে ১৯৮৩ সাল থেকে। এ সময় বাজার পুঁজিকরণ ৮১ কোটি ২০ লাখ টাকায় পৌঁছায়। ১৯৮৭ সালে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৯২টি। তবে শেয়ারবাজার সবার আলোচনায় আসে ১৯৯০-এর পর থেকে। তবে সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল বাজারের দুই ধস।
দেশের শেয়ার বাজারের প্রথম ধস নেমেছিল ১৯৯৬ সালে। আমি তখন নবীন সাংবাদিক। তখন হাতবদল হত কাগুজে শেয়ারের। এখনকার মতো সেন্ট্রাল ডিপজিটরি ব্যবস্থা ছিল না। বাজারে ছিল জাল শেয়ারের ছড়াছড়ি। মতিঝিল এলাকায় নিত্য যানজট লেগে থাকতো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেনাবেচা হতো বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার। বাজার ছিল কারসাজিকারীদে হাতে। প্রতিদিন কাজ ছিল মতিঝিল এলাকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের লেনদেন দেখা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভবনও ছিল তখন জমজমাট। গুজবের ডালপালা ছড়াতো এই মতিঝিল এলাকা থেকেই। ডিএসই ভবনে ফাটল, ধসে পড়বে–সেই সংবাদ ছড়িয়েও বাজারের শেয়ারের দর ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরে ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল দলটি। অর্থনীতি ভালো হচ্ছে, মানুষের আস্থা বেড়েছে, বাজারও আরো বাড়বে– এই প্রত্যাশাই ছিল কারসাজিকারীদের প্রধান হাতিয়ার। কোম্পানি ভালো না মন্দ, উৎপাদনে আছে কি নেই, দর অতিমূল্যায়িত না কম–কোনো কিছুই বিবেচনায় নেয়নি কেউ। কাগুজে শেয়ার হাতে নিয়ে কে কতবড় লাখপতি হলেন–প্রতিদিনই এই হিসাব কষতে বসতেন অনেকেই।
নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ১৯৯৬ এর মতিঝিলের রাস্তায় শেয়ার বেচাকেনার সেই দৃশ্য কল্পনাও করতে পারবেন না। শেয়ার সার্টিফিকেট ধরা হাত উঁচিয়ে ‘বাই, সেল, বাই, সেল’–বলতে থাকা দৃশ্য অনেকটা সিনেমার টিকিট বিক্রির মতোই। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে যেমনটা সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন, ‘মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান’, সত্যিকার অর্থেই সে সময়ে শেয়ারবাজারে মানুষ এসেছিল ‘বানের লাহান।’ যত দ্রুত মানুষ এসেছিল, বাজারে ততটাই দ্রুত পতন ঘটেছিল। তারপরের ইতিহাস মূলত তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন জমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
২০১১ সালের ধসের আরেকটি কারণ ছিল, ১৯৯৬ এর ঘটনায় কারোই বিচার হয়নি। ফলে কারসাজীরা জানতেন, একই ঘটনা আবার ঘটালেও বিচার হবে না। তাদের ধারণা যে সঠিক ছিল তা প্রমানিত।
সেই আওয়ামী লীগই আবার সরকার গঠন কর ২০০৯ সালে। আবারও সেই সীমাহীন প্রত্যাশা। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই এ নিয়ে অতি সতর্ক থাকে। ফলে তাদের সময় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন একটু বাড়তি মনোযোগ পায়। কিন্তু ৯৬ এর শেয়ার কেলেঙ্কারির ইতিহাস নিয়েও দলটি শেয়ার বাজার নিয়ে বাড়তি সতর্ক ছিল না। ৯৬ এর ধসের সঙ্গে জড়িতদের একটি বড় অংশ শেয়ারবাজারে আবার সক্রিয় হয়, তদারকিও ছিল ঢিলেঢালা। শেয়ার বাজারের উত্থান সরকারের প্রতি আস্থার প্রকাশ–এ কথা ৯৬ এর মতো আবারও বলা শুরু হয়েছিল।
এমনকি বাজার ধসের ঠিক আগে ২০১০ এর শেষের দিকেও সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বাজার মোটেই অতিমূল্যায়িত না, আর ৯৬ এর মতো ধস নামারও আশঙ্কা নেই। সে সময় সতর্ক করে দেওয়া তো দূরের কথা, বরং শেয়ার কেনার ঋণ সীমা বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আরও প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। ফলাফল হচ্ছে বাজারের আবার ধস। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ওই দুবারই শেয়ারবাজারে ধস দেখেছে।
২০১১ সালের ধসের আরেকটি কারণ ছিল, ১৯৯৬ এর ঘটনায় কারোই বিচার হয়নি। ফলে কারসাজীরা জানতেন, একই ঘটনা আবার ঘটালেও বিচার হবে না। তাদের ধারণা যে সঠিক ছিল তা প্রমানিত।
শেয়ারবাজারের এই ধসের কারণ একটাই–সীমাহীন প্রত্যাশা জাগিয়ে বিনিয়োগকারীদের বাজারে টেনে আনা। এরপরের কাজটি বাজার কারসাজীকারীদের। বাজার আরো বাড়বে–এই আশ্বাস ও বক্তৃতার কারণে কারসাজি করাটা হয়েছিল সহজ। আর বাজারের সব ধরনের কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তায় কারসাজি করাও সহজ হয়। কখনো কখনো কর্তৃপক্ষ বরং কারসাজীকারিদেরই সহায়তা করেছিল। সরকার ধরে নিয়েছিল বাজারে উর্ধমুখী ধারা সরকারের প্রতি জনগনের আস্থার ফল।
বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারী নিয়ে ‘গ্রেটার ফুল থিওরি’ বলতে একটি কথা আছে। দুই অর্থনীতিবিদ আবদুল বায়েস ও মাহবুব হোসেন তাঁদের বইতে এর বাংলা করেছেন বোকারাম তত্ত্ব। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে বুদবুদ সুষ্টির পেছনে কাজ করে এক ধরনের উচ্চাভিলাষী বোকা খেলোয়াড়, যারা তাদের চেয়েও বড় বোকাদের কাছে বিক্রি করার প্রত্যাশায় আরও বেশি দামে শেয়ার কেনে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বুদবুদ চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত এই অতিমূল্যায়িত সম্পদ বিক্রির জন্য তার চেয়েও বোকার সন্ধান না পায়। বুদবদ সেখানেই শেষ হবে যখন অপেক্ষাকৃত বেশি বোকা নিজেই সবচেয়ে বড় বোকা হয়ে সবচেয়ে বেশি দাম দিয়ে কেনার মতো বোকা আর খুঁজে পাবে না। বাজারে এই জাতীয় বোকারা থাকেই, সুতরাং পতনেরও আশঙ্কা থাকে পদে পদে।
২০১০ এর পতনের পরে সবারই আশা ছিল এবার বাজার ঠিক হবে। পতনের পর পরই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত পুনর্গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নতুন মুখ নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান হন এম খায়রুল হোসেন। করা হয় নতুন নতুন আইন। বাজারে আসে নতুন নতুন কোম্পানি। এমনকি এই নেতৃত্ব বহাল থাকে টানা নয় বছর। কিন্তু বাজার ভালো হয়নি। বলা চলে, মন্দা থেকে দাঁড়াতে পারেনি বাজার। বাজার ঘুরে না দাঁড়ালেও কারসাজি বন্ধ ছিল না, কর্তৃপক্ষের নিস্কিৃয়তাও ছিল আগের মতো। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি এনে বাজারকে আরও সংকটে ফেল দেয় তারা।
ফলে বাজার থাকে আগের মতোই আস্থাহীন ও অস্থিতিশীল। এতে পুঁজি হারায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। প্রতিবাদে টানা বিক্ষোভ হয়েছে, আবার সেই বিক্ষোভ ঠেকাতে ভিন্ন পথও বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাজার ঠিক করতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ ছিলেন সাবেক বিএসইসি। এমনকি কোনো কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কেনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি তারা। গত প্রায় এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল, ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আয় বেড়েছে মানুষের। কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন শেয়ারবাজারে ছিল না। নয় বছর টানা চেয়ার আকড়ে ধরে রাখলেই যে বাজারের স্থিতিশীলতা আসে না এর প্রমাণ ছিল খায়রুল হোসেন কমিশন।
শেয়ারবাজারে আবার নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এসেই অবশ্য তিনি নতুন নতুন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। শুরুতেই একটি বার্তা দিতে পেরেছেন তিনি। কিছু করলে পার পাওয়া যাবে না এই বার্তাটাই দিতে পেরেছেন তিনি। অনিয়মের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানিকে বড় অংকের জরিমানা করেছেন। ভালো কিছু কোম্পানিকে বাজারেও আনতে পারছেন। দেশীয় বড় কোম্পানি ওয়ালটন বেশ ভালো ভাবেই লেনদেন শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি মূলধন নিয়ে বাজারে আসছে রবি। সব মিলিয়ে একটা আস্থার পরিবেশ দেখা যাচ্ছে।
১৯২৯ সালের ওয়ালস্ট্রিট ধসের বড় কারণ ছিল অনুমান, প্রত্যাশা আর উচ্ছাস। দেশে ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের ধসের পেছনেও ছিল এই একই কারন, অনুমান, প্রত্যাশা আর উচ্ছাস। আগের বিএসইসির ওপর কারো তেমন আস্থা ছিল না। চেয়ারম্যান বদল হলে আস্থা ফিরবে এমনটাই বলা হচ্ছিল বেশ কয়েকবছর ধরে। এখন চেয়ারম্যান বদল হয়েছে। সুতরাং বদল হলে আস্থা কিছুটা হলেও ফিরবে সেই অনুমান ঠিক হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যানের বেশ কিছু পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেই প্রত্যাশা যদি উচ্ছাসে পরিণত হয়, তাহলেই ঘটবে বিপদ। নতুন চেয়ারম্যানের বড় কাজ হবে এটাই।
শেয়ার বাজার মানেই সরকার সূচক ঠিক করে দেবে না; শেয়ারবাজার মানেই প্রতিদিন দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে না; শেয়ারবাজার মানেই কখনো লোকসান, কখনো লাভ; শেয়ারবাজার মানেই যৌক্তিক আচরণ। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শেয়ার বাজারের একটি চিত্র সবার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি এটাও বলে দিতে হবে, এটা ঝুঁকির বাজার। ঝুঁকি নেওয়া শিখতে হবে। নইলে আছে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র। আর শেয়ারবাজার কখনোই বিকল্প কর্মসংস্থানের জায়গা নয়। শেয়ারবাজার হোক বুদ্ধিমান ও যৌক্তিক আচরণের বিনিয়োগকারীদের বাজার। এই বাজার যেন সেই সব বোকারামদের বাজারে পরিণত না হয়, যারা আরও বোকাদের অপেক্ষায় থাকে।
সবশেষে স্পেনে জন্ম নেওয়া কবি, উপন্যাসিক ও দার্শনিক জর্জ সান্তানার (১৮৬৩-১৯৫২) বিখ্যাত উক্তিটি বলে যাই। তিনি বলেছিলেন, ‘যারা অতীত মনে করতে পারে না, দণ্ডনীয়ভাবে তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে’। সুতরাং অতীত মাথায় থাকুক, ভুলেরও পুনরাবৃত্তি না ঘটুক।