শেয়ারবাজারে নতুন ৩০ ট্রেক
রাজনীতিবিদ, ক্রিকেটারও পাচ্ছেন সনদ
গত মঙ্গলবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্রোকার–ডিলারের সনদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শেয়ার ব্যবসার জন্য নতুন করে ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ব্রোকার–ডিলার সনদ দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অধীনে ট্রেডিং রাইট এনটাইটেলমেন্ট সার্টিফিকেট বা ট্রেক সনদ পাবে, যে সনদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার ব্যবসায় যুক্ত হবে।
প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাংসদ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়ের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আছে শিল্পগোষ্ঠী, একাধিক ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়, এমন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্রোকার বা ডিলার সনদের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে সম্পন্ন হওয়া স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনের ধারাবাহিকতায় সাত বছর পর এসে নতুন ট্রেক ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন ট্রেক ইস্যুর জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদন আহ্বান করে ডিএসই। ৬৬টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে ডিএসই যাচাই–বাছাই করে ৫১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠায় বিএসইসিতে। পরে বিএসইসি বাতিল করা ১৫টি থেকে ৩টিকে যোগ্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়। সেই ৫৪টি থেকে প্রথম পর্যায়ে ৩০টিকে অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। ১৯৫২ সালে ডিএসইর কার্যক্রম শুরুর পর ২০০৪–২০০৫ সময়ে একসঙ্গে ৩৮টি সদস্যপদ বিক্রি করেছিল ডিএসই। এরপরই এবার একসঙ্গে এত ব্রোকার-ডিলারের অনুমোদন দিল বিএসইসি।
জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ৩০টিকে অনুমোদন দিয়েছি। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লেনদেন ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাকিদের আবেদন আরও যাচাই–বাছাই করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের কাছে যেসব আবেদন এখনো জমা আছে, সেগুলোকে আমরা বাতিল করিনি।’
নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে লেনদেনে যুক্ত করলে তাতে পুরোনো মালিকদের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রভাব কমবে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান বাজারবাস্তবতায় ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক চেয়ারম্যান, বিএসইসি
সাংসদ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা পেলেন
ফেনী থেকে নির্বাচিত সাংসদ নিজামউদ্দিন হাজারীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্নিগ্ধা ইক্যুইটিজ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সাংসদ নিজে, আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম।
এ ছাড়া খুলনা থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর মালিকানাধীন ট্রাইস্টার সিকিউরিটিজ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মুর্শেদী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক পোশাক খাতের ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান মৃধা। আর প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক হিসেবে আছেন বিজিএমইএর পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান মৃধা ও ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেনের ভাই শেখ জাকির হোসেন।
জানতে চাইলে আবদুস সালাম মুর্শেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নতুন ট্রেকের জন্য আবেদন করেছিলাম। শুনেছি আমাদের প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
নেত্রকোনা থেকে নির্বাচিত সাংসদ মানু মজুমদারের প্রতিষ্ঠান সেলেসটিয়াল সিকিউরিটিজও নতুন ট্রেকের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সাংসদ আছেন চেয়ারম্যান হিসেবে। এর বাইরে এমডি ও পরিচালক হিসেবে রয়েছেন আরও চারজন।
তিন সাংসদের বাইরে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমানের ছেলে ও মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা রাশেক রহমানের মালিকানাধীন ট্রেড এক্স সিকিউরিটিজ। প্রতিষ্ঠানটিতে আরও রয়েছেন রাজনীতিবিদ এ কে ফাইজুল হক ও ব্যবসায়ী সাফকাত মতিন।
রাজনীতিবিদ ও সাংসদের প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, আইনে রাজনীতিবিদদের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। নিয়ম মেনে আবেদন করায় তাঁদের আবেদন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী ও খেলোয়াড়দের মধ্যে যাঁরা পেলেন
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের শুভেচ্ছাদূত ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংসও প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে শেয়ার ব্যবসার ব্রোকার–ডিলার হিসেবে সনদ পাওয়ার। প্রতিষ্ঠানটি নতুন ট্রেকের আবেদনের সঙ্গে যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছে, সেখানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সাকিব আল হাসান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন কাজী সাদিয়া হাসান। পরিচালক জাভেদ এ মতিন ও আবুল কালাম মাতবর।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রামভিত্তিক ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের এমডি আমীর আলীহুসেইন, ইস্টার্ণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া সিকিউরিটিজ, টি কে গ্রুপের টি কে শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেনের মালিকানাধীন মীর সিকিউরিটিজ, জাজ ভূঁইয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান ভূঁইয়ার মালিকানাধীন মাহিদ সিকিউরিটিজ, বারাকা পাওয়ারের মালিকানাধীন বারাকা সিকিউরিটিজ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেএমআই সিরিঞ্জের মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপের এমডি আবদুর রাজ্জাকের থ্রিআই সিকিউরিটিজ। চট্টগ্রামভিত্তিক কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানসহ গ্রুপের একাধিক শীর্ষ ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান কেডিএস শেয়ারস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, শেয়ারবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মাশরিব জাহিদের মালিকানাধীন এসএফআইএল সিকিউরিটিজ উল্লেখযোগ্য।
আরও যাঁরা অনুমোদন পেলেন
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ, সিএসইর অপর সদস্য প্রতিষ্ঠান কবীর সিকিউরিটিজ, আরএকে ক্যাপিটাল ও প্রুডেনশিয়াল ক্যাপিটাল। এর বাইরে যমুনা ব্যাংকের যমুনা সিকিউরিটিজ, আল হারামাইন গ্রুপের আল হারামাইন সিকিউরিটিজ, এনআরবি ব্যাংক সিকিউরিটিজ, সাউথ বাংলা ব্যাংক সিকিউরিটিজ, বিমা খাতের কোম্পানি তাকাফুল ইসলামী সিকিউরিটিজ ও অগ্রণী ইনস্যুরেন্স সিকিউরিটিজ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বারাকা পাওয়ারের বারাকা সিকিউরিটিজ।
বিএসইসির প্রাথমিক অনুমোদনের পর ডিএসই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও জামানত গ্রহণের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও বিএসইসিতে পাঠাবে। বিএসইসি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনাবেচার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
ডিএসইর সক্রিয় ব্রোকারেজ কত
বর্তমানে ডিএসইর সদস্যভুক্ত ২৫০টি ব্রোকারেজ হাউস রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি ব্রোকারেজ হাউসের মালিকানার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ২৪৬টি ব্রোকারেজ হাউসের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ২৩৮টি। বাকি ৮টি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ থাকলেও লেনদেনে সক্রিয় নয় তারা। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের আগে ডিএসইর একেকটি ব্রোকারেজ হাউসের দাম উঠেছিল ১০০ কোটি টাকার ওপরে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মালিকানা হাতবদল হওয়া চৌধুরী সিকিউরিটিজ নামের ব্রোকারেজ হাউসটির দাম উঠেছিল ৩২ কোটি টাকা। বেসরকারি একটি ব্যাংক সেটি কিনেছিল।
ডিএসই নতুন যে ট্রেক ইস্যু করছে, সেখানে জামানত হিসেবে একেকটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি টাকা ও নিবন্ধন ফি হিসেবে এক কোটি টাকা জমা দিতে হবে। আর দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ কোটি টাকার মধ্যেই একেকটি ট্রেকের অনুমোদন পাওয়া যাবে। এ কারণে শুরুতে ডিএসইর একটি অংশ এত কম দামে ট্রেক ইস্যুর বিরোধিতা করে। এমনকি এ নিয়ে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়। এ কারণে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএসইসির সাবেক কমিশন উদ্যোগ নিয়েও নতুন ট্রেক ইস্যু করতে পারেনি।
নতুন ট্রেক ইস্যুর বিষয়টিকে বাজারের জন্য ইতিবাচক বলেই মনে করছেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে লেনদেনে যুক্ত করলে তাতে পুরোনো মালিকদের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রভাব কমবে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মালিকানা থেকে লেনদেন পৃথক করা। যেটি নতুন নতুন ট্রেড ইস্যুর মাধ্যমে করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়েছে, সেখানে প্রতিবছর নিয়ম করে নির্দিষ্টসংখ্যক নতুন ট্রেক ইস্যু করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সেটি করা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান বাজারবাস্তবতায় ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।