ভাগ্যিস, বন্ধ ছিল শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজার
শেয়ারবাজার

ভালো একটা দিন গেল শেয়ারবাজারের জন্য। গতকাল সোমবার ছিল দেশের অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর জন্য স্বস্তির একটি দিন। গতকাল নতুন করে কোনো শেয়ারের দাম কমেনি। বাজারের সূচকেরও বড় পতন ছিল না। কারণ, বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল শেয়ারবাজারে লেনদেন ছিল বন্ধ।

দেশের শেয়ারবাজারে এখন লেনদেন হওয়া মানেই আবার দরপতন। সূচক কত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দরপতন কত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ—এসব তথ্য খুঁজে বের করতে হয় প্রতিনিয়ত। দেশের শেয়ারবাজারে এখন রেকর্ডের এতই ছড়াছড়ি যে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়েও শচীন টেন্ডুলকার এত রেকর্ড করতে পারেননি। শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকায় রেকর্ড বই একটি দিনের জন্য রেহাই পেল বলা যায়।

চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্ট। সেই সূচকই গত রোববার নেমে এসেছে ৪ হাজার ৪৯৮ পয়েন্টে। অথচ এ সময়ে অর্থনীতি এগিয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড হয়েছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারকে উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া কম কৃতিত্বের নয়। গত রোববার মূল্যসূচক যেখানে নেমে এসেছে, এর আগে তা ছিল তিন বছর আগে। অর্থাৎ গত রোববার এক ধাক্কায় সূচক তিন বছর আগের জায়গায় ফিরে গেছে। অথচ এই তিন বছরে জিডিপির আকার বেড়েছে ৯ লাখ কোটি টাকা। সুতরাং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সূচক সাড়ে চার হাজার পয়েন্টের নিচে বা টাইম মেশিন ছাড়াই সূচক তিন বছর আগের কাতারে নামিয়ে আনার কৃতিত্ব অর্জনের পর লেনদেন এক দিন বন্ধ থাকা যথেষ্ট স্বস্তির।

বাংলাদেশে কিন্তু শেয়ারবাজার নজরদারির জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। অবশ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও বিশ্বাস করেন না যে তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় এই সংস্থা নিয়োজিত। বরং বাজারের আচরণ বলে উল্টোটা। কারসাজিকারীদের রক্ষাই যেন তাদের কাজ। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ১০ বছরে যত নতুন শেয়ার বাজারে এনেছে, তার বড় অংশে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া যত ধরনের পদক্ষেপ তারা নিয়েছে, সেগুলোও অনুকূলে যায়নি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। আর যারা কারসাজি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণও বিরল। যত ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা-ও শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি।

সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আস্থাহীনতা এতটাই যে তাদের নেওয়া কোনো পদক্ষেপেই আর বিশ্বাস করেন না কেউ। বাজারের প্রতি আস্থাহীনতা ও বিএসইসির প্রতি আস্থাহীনতা যেন সমার্থক হয়ে গেছে।

স্বাধীনতার ১৯৭৬ সালে নতুন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম শুরু হলেও লেনদেন ভালোভাবে শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। এর ১০ বছরের মধ্যে প্রথম কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে শেয়ারবাজারে। ১৯৯৬ সালের সেই কেলেঙ্কারির পর অনেক আইনকানুন করা হয়, গঠন করা হয় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। এর ১৫ বছরের মধ্যে আবার কেলেঙ্কারি ঘটে শেয়ারবাজারে। এসইসির নাকের ডগায় বসেই কারসাজিকারীরা সর্বস্বান্ত করে দেয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। ২০১০ সালের সেই ঘটনার পর আবার পুনর্গঠন করা হয় এসইসিকে। তখন বলা হয়েছিল, আর কখনো শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি ঘটবে না। কথা রেখেছে তারা।

এখন আর একদিন সকালে উঠে কেউ দেখছেন না যে শেয়ারের দরে বিশাল পতন, এক দিনেই প্রায় শূন্য হয়ে গেছে সব বিনিয়োগ। বরং এখন বাজারের পতন ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই। ‘ম্যাচ ফিক্সিং’-এর মতো মাঝেমধ্যে বাজারকে কৃত্রিমভাবে টেনে ওপরে তোলা হয় ঠিকই, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। বরং স্থায়ী প্রবণতা হচ্ছে বাজারের অব্যাহত পতন। ফলে নতুন করে আর ঘোষণা দিয়ে কেলেঙ্কারি হচ্ছে না। কিছুদিন পরপর বৈঠক, তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ আর আশ্বাস দিয়ে এই বাজারকে এখন আর ঠিক করা যাবে না। বিনিয়োগকারীরা কেন আস্থাহীন, সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়াটাই একমাত্র পথ। এ জন্য শেয়ারবাজারে দরকার শুদ্ধি অভিযান, আর তা শুরু করতে হবে ওপর থেকেই।