বিশ্ব শেয়ারবাজারে বড় পতন, তেল উঠে গেল ১০৫ ডলারে

বৈশ্বিক শেয়ারবাজার এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও সোনার বাজার হঠাৎ আবার অস্থির হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর প্রথম দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বের বড় শেয়ারবাজারগুলোতে সূচকের ব্যাপক পতন ঘটেছে। এর মধ্যে খোদ এই হামলা পরিচালনকারী রাশিয়ার শেয়ারবাজারের সূচক ৪৫ শতাংশ কমেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে সাত বছর পর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি সোনার দামেও যেন আগুন লেগেছে।

ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও পতন ঘটছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার লন্ডনভিত্তিক আগাম কেনাবেচায় প্রতি ব্যারেল (৪২ মার্কিন গ্যালন বা ১৫৯ ব্রিটিশ লিটার) ব্রেন্ট ক্রুড জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়ে ১০৫ দশমিক ৩০ ডলারে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি ২০১৪ সালের পর জ্বালানি তেলের সর্বোচ্চ দাম। আগের দিন বুধবার প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ৯৯ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে গতকাল প্রতি ব্যারেল ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলের দাম ৮ শতাংশ বেড়ে ৯৯ দশমিক ৪৬ ডলারে উঠেছে। বুধবার প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই তেলের দাম ৯৬ ডলার পর্যন্ত উঠে আবার কিছুটা পড়ে গিয়েছিল। ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে—এমন আশঙ্কা এখন প্রবল। সিএমসি মার্কেটসের বিশ্লেষক টিনা টেং বলেছেন, দাম আরও বাড়বে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বেড়েছে। রুশ হামলার পরই প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া সেফ হ্যাভেন বা নিরাপদ বিনিয়োগ খ্যাত সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। পণ্যটির আউন্সপ্রতি (২৮ দশমিক ৪ গ্রাম) দাম ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯৬৮ ডলারে উঠে গেছে।

ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তিক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে তৃতীয় দিনের মতো সূচকের পতন ঘটেছে। তবে সবচেয়ে বড় পতনটি দেখেছে খোদ রাশিয়ার শেয়ারবাজার। দেশটির শেয়ারবাজারের মোয়েক্স সূচক ৪৫ শতাংশ কমেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে গত কয়েক দিনে অবশ্য রুশ শেয়ারবাজারের মূলধন ২৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার কমেছে। এ ছাড়া রুশ মুদ্রা রুবলের বিনিময় হারও ৩ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ে গেছে।

এশিয়ায় জাপানের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের নিক্কি ২২৫ সূচক ১ দশমিক ৮১, হংকংয়ের হেংসেং সূচক ৩ দশমিক ৮১, ভারতের বোম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্স সূচক ৪ দশমিক ৭২, চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বিত সূচক ১ দশমিক ৭১ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোস্পি সূচক ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।

এদিন যুক্তরাজ্যের লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচক ৩ দশমিক ২৭ ও এফটিএসই ২৫০ সূচক শূন্য দশমিক ৭২, নেদারল্যান্ডসের এইএক্স সূচক ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ফ্রান্সের প্যারিসের সিএসি ৪০ সূচক ৪ দশমিক ৯৩, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের ড্যাক্স সূচক ৫ দশমিক ৫ এবং ইউরো স্টকস সূচক ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমেছে।

সময়ের পার্থক্যের কারণে গতকাল রাত আটটায় এই লেখা তৈরি করার সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়নি। আগের দিন অবশ্য সেই দেশের ডাউজোন্স সূচক ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১ শতাংশ ৮৪ শতাংশ ও নাসড্যাক ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ পড়েছে।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করছিল, তখনই দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যক্তিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ এবং অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাতে কোনো কাজই হয়নি। কারণ, রাশিয়া না থেমে বরং গতকাল স্থানীয় সময় ভোরের দিকে পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) একযোগে স্থল, আকাশ ও নৌপথে হামলা চালিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশের ওপর আরেক দেশ এত বড় হামলা চালায়নি। প্রসঙ্গত, ইউক্রেনের ওই অঞ্চল রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাশিয়া গত সোমবার অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়।

শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ও বিরোধিতাকে পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববাজারে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম বা ১০ শতাংশ জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক হলো রাশিয়া। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব।

আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, বর্তমান ফেব্রুয়ারিতে ১০ শতাংশ ও গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১২৫ ডলারে এবং আগামী ২০২৩ সালে ১৫০ ডলারে উঠতে পারে। এর আগে ২০০৮ সালে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল দাম ১৪৭ ডলারে উঠেছিল, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

পশ্চিমা দুনিয়ার প্রবল বিরোধিতার মধ্যেই রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে দুই লাখ সেনা মোতায়েন করেছে। রুশ পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিদেশে সৈন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এরই মধ্যে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রের মহড়া শুরু করে।

সূত্র: বিবিসি, আনন্দবাজার পত্রিকা, সিএনবিসি