আইপিওর ক্ষেত্রে নতুন বিধান
বিনিয়োগ বাড়াবে শেয়ারবাজারে
বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিধানের ফলে আইপিওতে আবেদন যেমন বাড়বে, তেমনি সেকেন্ডারি বাজারেও নতুন বিনিয়োগ আসবে।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর লটারি তুলে নেওয়া ও আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা। আইপিও আবেদন করতে হলে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম বিনিয়োগের যে বিধান করা হয়েছে, সেটিকেও স্বাগত জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্ট সবাই।
গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইপিওতে লটারিপদ্ধতি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি আইপিও আবেদনের আগে একজন বিনিয়োগকারীর সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া আইপিও আবেদনের ন্যূনতম চাঁদা নির্ধারণ করা হয় ১০ হাজার টাকা। তবে আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধ্বসীমা রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, যখন কোনো আইপিওতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আবেদন (ওভার সাবস্ক্রিপশন) জমা পড়বে, তখন প্রত্যেক আবেদনকারী একজন আবেদনকারী ধরে তার ভিত্তিতে শেয়ার বণ্টন করা হবে। আর যখন প্রয়োজনের চেয়ে কম আবেদন (আন্ডার সাবস্ক্রিপশন) জমা হবে, তখন যিনি যত টাকার আবেদন করেছেন, তার ভিত্তিতে শেয়ার বণ্টন করা হবে।
এদিকে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসির নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ যেমন বাড়বে, তেমনি আইপিওতে আবেদনও অনেক গুণ বেড়ে যাবে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দুইটি অংশ আছে। তার মধ্যে একদল সেকেন্ডারি বাজারে নিয়মিত লেনদেন করেন। অন্য দলটি শুধু আইপিও বাজারনির্ভর। বিএসইসির নতুন বিধানের ফলে সেকেন্ডারি বাজারের বিনিয়োগকারীরাও যেমন আইপিওতে আবেদনে আগ্রহী হবেন, তেমনি আইপিও আবেদনকারীদের সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম বিনিয়োগ করতেই হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, আইপিওর ক্ষেত্রে লটারি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো। এতে করে আইপিওতে আবেদনকারী অনেক বেড়ে যাবে। কারণ আবেদন করলেই সবাই কমবেশি শেয়ার পাবেন।
সম্প্রতি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে বড় মূলধনী কোম্পানি রবির আজিয়াটার আইপিওতে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার বিও (বেনিফিশারি ওনার্স) হিসাব থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন আবেদনকারী লটারির পর রবির ৫০০ করে শেয়ার পেয়েছেন। যদি এসব বিনিয়োগকারীর আইপিও আবেদনের আগে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বা সেকেন্ডারি বাজারে ২০ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করতে হতো, তাহলে সেকেন্ডারি বাজারে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসত।
একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংকার বলছেন, আইপিও আবেদনের আগে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম বিনিয়োগের বিধানের ফলে বাজারে যেসব নতুন বিনিয়োগ আসবে, তা ঘুরেফিরে দীর্ঘমেয়াদে বাজারে থাকবে। কারণ, আইপিওতে আবেদন করতে হলেই ন্যূনতম বিনিয়োগ দেখাতে হবে। তাই যেসব বিনিয়োগকারী শুধু আইপিওতেই বিনিয়োগ করেন, তাঁরা নির্দিষ্ট পরিমাণ একটি অর্থ দীর্ঘমেয়াদি সেকেন্ডারি বাজারে বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে রাখবেন।
প্রসঙ্গত শেয়ারবাজারে আইপিওর কাজটি করে থাকে মার্চেন্ট ব্যাংক। তাদের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে আইপিও প্রক্রিয়ার সময় ও খরচ কমিয়ে আনার কথা বলে আসছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। এ জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকারদের অনেকে বিএসইসির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে লটারি পদ্ধতি তুলে নেওয়ার কথা বলে আসছিলেন।
সাধারণত যারা শেয়ারবাজারে আইপিওকেন্দ্রিক ব্যবসা করেন, তাঁদের কেউ কেউ আইপিওতে আবেদনের জন্য বিভিন্ন নামে বছরের পর বছর শত শত বিও হিসাব সংরক্ষণ করে থাকেন। শুধু আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে এসব বিও হিসাব ব্যবহার করা হয়। এতে লটারিতে আইপিও শেয়ার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শুধু এ কারণেই বার্ষিক মাশুল দিয়ে অনেকে বিভিন্নজনের নামে বিও হিসাব সংরক্ষণ করেন। আইপিওতে আবেদন করে শেয়ার না পেলেও পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যায়, তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার ও বিও হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের হিসাবে, গত ৩১ ডিসেম্বর শেষে শেয়ারবাজারে সক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৪ হাজার বিও হিসাব শেয়ারশূন্য অবস্থায় আছে। এসব বিও হিসাবের বড় অংশই মূলত আইপিও আবেদনের জন্য ব্যবহার হয়।
যদি এ ছয় লাখ বিও হিসাব থেকে আগামীতে আইপিও আবেদন করতে হয়, তাহলে প্রত্যেক বিও হিসাবের বিপরীতে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করতে হবে। তাতে সেকেন্ডারি বাজারে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ আসবে।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেন, লটারি পদ্ধতি তুলে দেওয়ার ফলে আইপিওতে আবেদনকারী অনেক বেড়ে যাবে। কারণ, সবাই শেয়ার পাবেন, এ নিশ্চয়তা থেকে সবাই আবেদন করবেন। এ ছাড়া আইপিও আবেদনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগের যে সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তাতে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ বাড়বে। পাশাপাশি আইপিওর জন্য শত শত বিও হিসাব সংরক্ষণের প্রবণতাও কমে যাবে।