শেয়ারবাজার পর্যালোচনা
বাজে একটি সপ্তাহ পার করলেন বিনিয়োগকারীরা
চলতি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে ছিল গত সপ্তাহটি। সপ্তাহ শেষে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।
আগের সপ্তাহের চেয়ে মোট লেনদেন কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ।
লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৬ শতাংশেরই বা ২৯৭টির দাম কমেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের মতো বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরাও বাজে একটি সপ্তাহ পার করেছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনায় বিশ্বের বড় বড় শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তেমনি এ দেশের বিনিয়োগকারীরা খুইয়েছেন পুঁজি।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার লেনদেন হওয়া সব প্রতিষ্ঠানের দাম সম্মিলিতভাবে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। আর গত সপ্তাহের চার কার্যদিবসের লেনদেনের তথ্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এ চার দিনে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। সেই বিবেচনায় বলা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বাজে একটি সপ্তাহ পার করেছেন দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। কারণ, এমন সপ্তাহ তাঁরা গত দুই মাসে দেখেননি।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ঢাকার বাজারে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৬ শতাংশেরই বা ২৯৭টির দাম কমেছে। বেড়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ বা ৭৩টির দাম। অপরিবর্তিত ছিল প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বা ১৭টির দাম। আর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৫২ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহের চেয়ে মোট লেনদেন কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ। সপ্তাহ শেষে দৈনিক গড় লেনদেনও আগের সপ্তাহের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯৯৭ কোটি টাকায়।
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত দুটি কারণে গত সপ্তাহে বাজারে এমন মন্দাভাব ছিল। দুটি কারণের মধে৵ একটি স্থানীয়, অন্যটি বৈশ্বিক। স্থানীয় কারণটি হলো শেয়ারবাজারের বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণাত্মক ঋণ হিসাব সমন্বয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনা। আর বৈশ্বিক কারণটি ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। এ দুই কারণে সপ্তাহজুড়েই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল বেশ নড়বড়ে। যার প্রভাব শেয়ারবাজারে দেখা গেছে সপ্তাহের শেষে।
বিনিয়োগকারীসহ বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, যে দুটি কারণে সপ্তাহজুড়ে বাজারে মন্দাভাব ছিল, সেই কারণ দুটি কতটা যৌক্তিক! সপ্তাহজুড়ে প্রায় ১০টি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই দুটি কারণে বাজারে যতটা না যৌক্তিক প্রভাব পড়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব ছিল মনস্তাত্ত্বিক। আমাদের মতো দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবই বেশি দেখা যায়।
বিএসইসি সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ঋণাত্মক ঋণ হিসাবকে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ আগামী বছরটি যখন শুরু হবে, তখন যাতে শেয়ারবাজারের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণাত্মক ঋণ হিসাব না থাকে। যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তবে সেটি দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের জন্যই মঙ্গলজনক। কারণ, বছরের পর বছর এ ধরনের হিসাবগুলোকে জিইয়ে রেখে সেগুলোর অপব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শেয়ারবাজারে অনাদায়ি ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলোর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছিল ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে ওই সময় নিয়ম না মেনে শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীদের সীমার বেশি ঋণ দিয়েছিল। বাজারে ধস নামার পর সেসব ঋণ আর আদায় হয়নি। তাতে বিনিয়োগকারীরা যেমন নিজের পুঁজি হারান, তেমনি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া ঋণও আটকে যায়।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারবাজার ধসের পর এরই মধ্যে ১১ বছর পার হয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাজার ছেড়েছেন। ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারী অনেকের হদিসও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঋণ হিসাবগুলোকে জিইয়ে রেখেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আদৌ এসব ঋণ কখনো ফেরত আসবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ, সেসব ঋণ হিসাব জিইয়ে রেখে লাভটা কার? ব্যাংক খাতে অনাদায়ি ঋণ যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর অবলোপন করা হয়, তেমনি শেয়ারবাজারেও অনাদায়ি ঋণাত্মক ঋণ হিসাব অবলোপন করা সময়ের দাবি। তাতে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ভিত্তিই শক্তিশালী হবে বলেই মনে করেন বাজার–বিশ্লেষকেরা।
অন্যদিকে, ইউক্রেনে রুশ হামলার ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ দেশের বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়াটাও কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর শীর্ষ পর্যায়ের এক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হুজুগে চলেন বেশি। এ কারণে তাঁরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হন।