সরবরাহ সংকট
বাজারে মোটরসাইকেলের টান
দেশে দুই কারণে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ কম আমদানি হচ্ছে। এ কারণে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই।
জুন ও জুলাই মাসে বেশ ভালো বিক্রি করেছেন বিপণনকারীরা।
করোনা, বন্যা ও বর্ষার কারণে আগস্টে চাহিদা কিছুটা কম।
দেশে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। ভরা মৌসুম মার্চ থেকে জুন।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাজারে মোটরসাইকেলের চাহিদা বেশ ভালো। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এ কারণে ক্রেতারা চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে পছন্দের মডেলের মোটরসাইকেল কিনতে পারছেন না। মোটরসাইকেলের সরবরাহ কম হওয়ার কারণ দুটি।
বাজারের সুপরিচিত ব্র্যান্ডের বিপণনকারীরা বলছেন, প্রথম কারণ হলো যেসব দেশ থেকে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ বেশি আমদানি হতো, সেখানে করোনা পরিস্থিতির কারণে তিন মাস কারখানা মোটামুটি বন্ধ ছিল। বিশেষ করে ভারতে। দ্বিতীয় কারণ হলো, এত দিন ব্র্যান্ডগুলো মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ রং করা অবস্থায় আমদানির সুযোগ পেত। নতুন বাজেটে এ সুবিধা আর রাখা হয়নি। এটা নিয়েও বিপাকে রয়েছে কোনো কোনো কোম্পানি। এ বিষয়ে জাপানের সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী র্যানকন মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে এত মোটরসাইকেলের চাহিদা থাকবে, তা কেউ আশা করেনি।
ওদিকে বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থায় একটা বিঘ্ন ঘটেছে। ফলে বাজারে সরবরাহে একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়, যা ৩ বছর আগেও দেড় লাখ ইউনিট ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) করোনার আঘাত আসে। গত এপ্রিল ও মে মাসে মোটরসাইকেল বিক্রি খুবই সামান্য ছিল। তবে জুন মাসে হঠাৎ করে চাহিদা অনেকটাই বেড়ে যায়, যা অপ্রত্যাশিত ছিল।
কোম্পানিগুলো বলছিল, এর কারণ দুটি। প্রথমত, দুই মাস বিক্রি মোটামুটি বন্ধ থাকার পর জুনে অনেকেই কিনে ফেলেন। দ্বিতীয় কারণ, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে অনেকেই মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য বাহন হিসেবে বেছে নেন। মোটরসাইকেলের বাজার জুলাই মাসেও তেজি ছিল। আগস্টে ততটা তেজ না থাকলেও চাহিদা আছে। সমস্যা হলো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর কারও কারও কাছে ততটা মজুত নেই, যতটা প্রয়োজন। দেশে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। ভরা মৌসুম হলো মার্চ থেকে জুন।
কোম্পানিগুলোর বিপণন কর্মকর্তাদের তথ্য হলো, এ সময় বোরো ধানসহ প্রধান কয়েকটি ফসল ওঠে, যা গ্রামে মোটরসাইকেল কেনা বাড়িয়ে দেয়। আবার এ সময়ে পয়লা বৈশাখ ও পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে মোটরসাইকেল কেনাবেচা বাড়ে। ভরা বর্ষায় আবার বিক্রি কম হয়। টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী টিভিএস অটো বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ‘আগস্ট মাসে আমরা চাহিদা একটু কম পাচ্ছি।’ তিনিও বৈশ্বিক সরবরাহ–সংকটের কথাই বললেন। দাবি করলেন, যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেখানে কারখানা আংশিক চালু রেখে পুরো চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, হিরো ও টিভিএস এবং জাপানের ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা এখন দেশেই তৈরি হয়। তাদের কিছু কিছু মডেলের মোটরসাইকেল সংযোজিত হয়। অন্যদিকে দেশীয় ব্র্যান্ড রানার অনেক আগে থেকেই দেশে মোটরসাইকেল তৈরি করছে। কোম্পানিগুলো কয়েক বছরে মোটরসাইকেল কারখানায় বিপুল বিনিয়োগ করেছে। মোটরসাইকেল খাতের দুই সংগঠন বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএএমএ) এবং মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এমএমইএবি) হিসাব অনুযায়ী, এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
উৎপাদনকারীদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। কেউ কেউ বাড়তি মূল্য সংযোজন করে, বেশি যন্ত্রাংশ তৈরি করে উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃত। কেউ কেউ আবার উৎপাদনকারী হলেও কিছু কিছু মডেলের মোটরসাইকেল বিযুক্ত অবস্থায় আমদানি করে সংযোজন করে। সব মিলিয়ে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয় সবাইকেই। বাজেট ঘোষণার পর শিল্প মন্ত্রণালয় গত ২২ জুন এক চিঠিতে মোটরসাইকেল খাতের বাজেট প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে কয়েকটি সুপারিশ পাঠায়। তার মধ্যে একটি ছিল, কোম্পানিগুলো প্রতি দুই বছর পরপর নতুন মডেল সংযোজন করে বাজার সম্ভাব্যতা যাচাই করে। বাজারে ভালো সাড়া পেলে দেশে তৈরি শুরু করে।
সিকেডি আমদানি করতে না পারায় কারখানার সিকেডি অংশ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এতে অনেকে বেকার হচ্ছেন।মতিউর রহমান, সভাপতি, বিএমএএমএ
এ কারণে রং করা বা ‘পেইন্টেড পার্টস অ্যান্ড কমপোনেন্ট’ আমদানির সুযোগ আরও পাঁচ বছর রাখা দরকার। বিএমএএমএর সভাপতি ও বাজাজ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান মনে করেন, সরবরাহের দিক দিয়ে কারও কারও যে সমস্যা রয়েছে, তা কিছুদিনের মধ্যেই কেটে যাবে। তাঁদের মূল সমস্যা এখন বিযুক্ত অবস্থায় (সিকেডি) মোটরসাইকেল আমদানি করতে না পারা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সিকেডি (রং ছাড়া অবস্থায় যন্ত্রাংশ) আমদানি করতে না পারায় কারখানার সিকেডি অংশ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এতে অনেকে বেকার হচ্ছেন।
মতিউর রহমান আরও বলেন, ‘নতুন একটি মডেল তৈরির ব্যবস্থা করতে চার কোটি টাকা খরচ হয়। এ জন্য আগে বাজার যাচাই করা জরুরি। আমরা নতুন মডেল সিকেডি অবস্থায় এনে বাজারে ছেড়ে দেখি ভালো সাড়া পাওয়া যায় কি না। সুযোগটি দেওয়া না হলে নতুন মডেলের মোটরসাইকেল দেওয়া যাবে না। এতে অবৈধ আমদানি বাড়বে।’