চাঙা শেয়ারবাজারে হঠাৎ করেই নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয়
শেয়ারবাজারের যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবারও সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ বা অর্থ ঢুকছে। এ অর্থ সবচেয়ে বেশি আসছে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এ কারণে বাজারে লেনদেনেও আবার নতুন করে গতি সঞ্চার হয়েছে।
গত দুদিনে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৮টি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে। যেসব ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে, সেসব ব্রোকারেজ হাউস ধারাবাহিকভাবে শেয়ারবাজারে লেনদেনকারী শীর্ষ ২০ ব্রোকারেজ হাউসের তালিকায় থাকে। বাজার ভালো থাকলে এসব ব্রোকারেজ হাউসে কোনো কোনোটিতে দিনে ৫০ থেকে ৮০ কোটি টাকারও লেনদেন হয়।
নতুন করে যাঁরা বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন, তাঁরা কোন শ্রেণির বিনিয়োগকারী, জানতে চাইলে ওই নির্বাহী বলেন, এঁদের মধ্যে বড় একটি অংশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা।
শীর্ষ এসব ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক দিনে বিশেষ করে ১৪ এপ্রিলের পর হঠাৎ করে নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। যাদের বড় অংশ গত কয়েক মাসে শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন। আবার এর মধ্যে কেউ কেউ নতুন বিনিয়োগও নিয়ে আসছেন। তবে এঁরা একেবারে নতুন বিনিয়োগকারী নন। আগে থেকেই বাজারে ছিলেন, মুনাফা তুলে নিয়ে সাময়িকভাবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে একটি অংশ সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি নতুন করে বাজারে অর্থলগ্নি করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একটি শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এদিন তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের হিসাবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক টাকায় গতকাল পুরোনো কয়েকজন বিনিয়োগকারী নতুন করে বাজারে বিনিয়োগ করেছেন।
নতুন করে যাঁরা বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন, তাঁরা কোন শ্রেণির বিনিয়োগকারী, জানতে চাইলে ওই নির্বাহী বলেন, এঁদের মধ্যে বড় একটি অংশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা।
বাজারে যে নতুন বিনিয়োগ আসছে তার প্রমাণ মেলে লেনদেনের চিত্র দেখে। গতকাল দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য ৪০০ কোটি টাকা ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়। সাধারণত ব্লক মার্কেটের লেনদেন নির্দিষ্ট একটি দিনের লেনদেন।
ব্রোকারেজ হাউসের নির্বাহীরা ধারণা করছেন, সরকারি বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। শিল্প, কলকারখানা চালু থাকলেও স্থানীয় বাজারনির্ভর বেশির ভাগ ব্যবসায় মন্দাভাব। আবার করোনার কারণে এক বছর ধরে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে বিনিয়োগও হচ্ছে না।এমন পরিস্থিতিতে বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা শেয়ার বাজারে টাকা খাটাচ্ছেন।
জানতে চাইলে শেলটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শেলটেক ব্রোকারেজের পরিচালক মঈন উদ্দিন আজ বুধবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক দিনে আমাদের পুরোনো বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নতুন করে বেশ কিছু অর্থ বাজারে বিনিয়োগের জন্য নতুন করে তাদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে জমা দিয়েছে। আরও কিছু বিনিয়োগকারী নতুন করে অর্থ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। যাঁরা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের বড় অংশই শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী শ্রেণির।
বাজারে যে নতুন বিনিয়োগ আসছে তার প্রমাণ মেলে লেনদেনের চিত্র দেখে। গতকাল দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য ৪০০ কোটি টাকা ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়। সাধারণত ব্লক মার্কেটের লেনদেন নির্দিষ্ট একটি দিনের লেনদেন। ওই লেনদেনকে তাই নিয়মিত লেনদেন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ব্লক মার্কেটের ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন বাদ দিলেও গতকাল মূল বাজারে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।
আমাদের বাজারের আচরণটাই এমন, যখন সূচক ও শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরাও বাজারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন।’
শেয়ারবাজারে বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। এ আড়াই ঘণ্টায় লেনদেন ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়াকে বাজারের চাঙাভাব বলেই অভিহিত করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, আগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টার লেনদেনের সময়কালে শুধু বাজার চাঙা থাকলে এ পরিমাণ লেনদেন হতো।
অন্যদিকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রহমত পাশা গতকাল মঙ্গলবার রাতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ গত কয়েক দিনে আবারও সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি অবশ্যই বাজারের জন্য ইতিবাচক দিক।
রহমত পাশা তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে এ–ও বলেন, ‘আমাদের বাজারের আচরণটাই এমন, যখন সূচক ও শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরাও বাজারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন।’
বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন লেনদেনও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তার কারণ শেয়ারের দাম বেড়ে যায়।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, একজন বিনিয়োগকারী ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন 'ক' নামের একটি কোম্পানির শেয়ারে। সেই শেয়ারের দাম বাড়ায় ওই বিনিয়োগকারীর ২৫ হাজার টাকা মুনাফা হয়েছে। এখন ওই বিনিয়োগকারী 'ক' কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে যদি 'খ' কোম্পানির শেয়ার কেনেন, তাহলে তিনি ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার শেয়ার কিনতে পারবেন। আবার ওই বিনিয়োগকারী যদি প্রান্তিক ঋণ (মার্জিন লোন) নিয়ে বিনিয়োগ করেন, তাহলে তাঁর বিনিয়োগ সক্ষমতা আরও বেশি বাড়বে। কারণ 'ক' কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের সময় তিনি ঋণ পেয়েছিলেন ১ লাখ টাকার বিপরীতে। এখন যখন 'ক' কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে 'খ' কোম্পানির শেয়ার কিনতে যাবেন, তখন ঋণ পাবেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিপরীতে।
সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ দিনে বাজারে নতুন করে প্রায় ১৩ হাজার বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে কমে গেছে অব্যবহৃত বিও হিসাবের সংখ্যা। গত ৩১ মার্চ বাজারে অব্যবহৃত বিও হিসাব ছিল ৪ লাখ ৬ হাজার ৭৪৮টি।
এদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন বাড়াতে সম্প্রতি প্রান্তিক ঋণ সীমাও বাড়িয়ে দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আগে ১০০ টাকার বিপরীতে একজন বিনিয়োগকারী ৫০ পয়সা ঋণ পেতেন। সেটি বাড়িয়ে এখন ১০০ টাকার বিপরীতে ৮০ টাকা (১ অনুপাতে শূন্য ৮ শতাংশ) করা হয়েছে।
এদিকে বাজারের এ চাঙাভাব ও লেনদেন বৃদ্ধি বাজারসংশ্লিষ্টদের আনন্দিত করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য শঙ্কা বা ভয়ের কারণও রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। কারণ, বাজারের এ চাঙাভাবের সুযোগে কারসাজিকারকেরা কিছু কিছু খাত ও কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছেন।
শেয়ারবাজারের বিও হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ দিনে বাজারে নতুন করে প্রায় ১৩ হাজার বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে কমে গেছে অব্যবহৃত বিও হিসাবের সংখ্যা। গত ৩১ মার্চ বাজারে অব্যবহৃত বিও হিসাব ছিল ৪ লাখ ৬ হাজার ৭৪৮টি। গতকাল মঙ্গলবার দিন শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৬৫৩টিতে। অর্থাৎ অব্যবহৃত ১৩ হাজারের বেশি নিষ্ক্রিয় বিও হিসাব সক্রিয় হয়েছে।