বিশ্লেষণ
ডিএসইতে এমডি টেকে না কেন
ডিএসইর প্রথম সিইও জি কিউ চৌধুরী ১৯৯৮–২০০০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করলেও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
২০০১ সালে রেজাউর রহমান সিইও হিসেবে ১০ মাস দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
২০০২ সাল থেকে ১৭ মাস ভারপ্রাপ্ত সিইওর দায়িত্ব পালন করেন মফিজউদ্দিন আহমেদ।
২০০৩–০৮ সাল পর্যন্ত দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেন সালাউদ্দিন আহমেদ খান। তিনিও মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে বিদায় নেন।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদটি পুরোপুরি ‘মিউজিক্যাল চেয়ারে’ পরিণত হয়েছে। আর এ চেয়ারের মিউজিক বাজিয়ে চলেছেন প্রভাবশালী ভাইয়েরা ও তাঁদের অনুগত ভাইয়েরা। ভাইদের বলয়ের বাইরে গিয়ে এ সংস্থায় দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
তাই এ পদে থেকে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করে মেয়াদ শেষ করতে পারা সৌভাগ্যবান এমডির সংখ্যা খুবই কম। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন ডিএসইর এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়া। ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পাওয়া এ এমডিকে পদ ছাড়তে হলো ১৩ মাসের মাথায়।
ডিএসইর চেয়ারম্যানের কাছে ই-মেইলে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, যেভাবে তিনি কাজ করতে চাচ্ছিলেন, সেভাবে কাজ করতে পারছেন না। তাই তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারও এমডির হঠাৎ পদত্যাগের পেছনে মূল কারণ ছিল সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে মতপার্থক্য। বেশ কিছুদিন ধরে ছোট ছোট নানা ইস্যুতে এ মতপার্থক্য চলে এলেও সম্প্রতি সেটি প্রকট হয়ে ওঠে শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতি ঘিরে। এমডি তাঁর ক্ষমতাবলে এ পদোন্নতি দেন।
তার মধ্যে কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি নিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত কিছু কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। সেই অসন্তোষ থেকে পরিচালনা পর্ষদের তোপের মুখে পড়তে হয় এমডিকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক পর্ষদ সভায় এ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হন তিনি। একপর্যায়ে তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সভা থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এরপর পদ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারিক আমিন ভূঁইয়া।
এবার দেখে নেওয়া যাক, আইন কী বলে। ডিএসইর ‘বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আইনের গভর্ন্যান্স স্ট্রাকচার অব এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক অধ্যায়ে এমডির দায়িত্ব হিসেবে বলা আছে, এক্সচেঞ্জের অবাধ, সুষ্ঠু, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করবেন। স্টক এক্সচেঞ্জের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে এমডিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু ডিএসইর বেশির ভাগ এমডিই সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হন। এ কারণে অনেকে নিজ সম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করেন, অনেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। এতে ডিএসই সম্পর্কে নেতিবাচক এক ইমেজই তৈরি হচ্ছে বাজারে। যার কারণে ভালো সুযোগ–সুবিধার পরও যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা এক্সচেঞ্জের এমডি হতে আগ্রহ দেখান না।
বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পর্ষদকে বাদ দিয়ে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে পর্ষদের কেউ কেউ যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তেমনি পদোন্নতিবঞ্চিত অনেকের ব্যক্তিগত আক্রোশের মুখেও পড়েছেন। কয়েক জন স্বতন্ত্র পরিচালক ক্ষুব্ধ হন এমডির বিরুদ্ধে।
অতীতেও এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সংস্থাটিতে। বিভিন্ন ইস্যুতে সাবেক বেশ কয়েকজন এমডিও তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে পর্ষদের কারও কারও বিরাগভাজন হয়ে বিদায় নিয়েছেন বা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এ কারণে সংস্থাটির এমডি পদে এখন যোগ্য ব্যক্তিদের অনেকেই আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই অতীতে এমডি পদ শূন্য হওয়ার পর কয়েক দফায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও যোগ্য লোক খুঁজে পায়নি সংস্থাটি। সর্বশেষ বর্তমান এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়ার নিয়োগের আগে প্রায় সাত মাস এ পদটি শূন্য ছিল।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ডিএসইর এমডির পদটির বেলায় ‘বদল’ই একমাত্র সত্য। যোগ্যতা, দক্ষতা, পেশাদারত্ব, সক্ষমতা—এসবই যেন এ পদের বেলায় মিথ্যা। শুধু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এসব বিষয়ের উল্লেখ থাকে। এ পদে থেকে পেশাদারত্ব চর্চা করতে গেলেই লাগে গন্ডগোল। গত ২২ বছরে ডিএসইর ১১ জন (বর্তমান এমডি বাদে) এমডি বদল হয়েছেন।
এর মধ্যে কেবল তিনজন পূর্ণ মেয়াদে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। অন্যদের মেয়াদ পূর্তির আগেই হয় স্বেচ্ছায় বিদায় নিতে হয়েছে, নয়তো বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। একসময় ডিএসইতে ছিল ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ডিএসইতে ২৫০ সদস্য থাকলেও আধিপত্য বিস্তারের কাজটি করতেন হাতে গোনা কয়েকজন। তাঁদের হাত ধরেই অনেকে নিয়োগ পান ডিএসইতে। এ কারণে ভাইদের আনুকূল্য পাওয়া ভাইয়েরাও প্রভাব বিস্তার করেন নানাভাবে।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের এ প্রভাব ও ক্ষমতার বলয় থেকে ডিএসইকে মুক্ত করতে ২০১৪ সালে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছিল। কিন্তু ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আট বছর পর এসেও ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন’।
কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে মিলে নিজেদের পছন্দের স্বতন্ত্র পরিচালক বাছাই করে নিয়ে আসেন এই মালিকেরা। ফলে স্বতন্ত্র পরিচালকেরা কার্যত হয়ে গেছেন মালিকদেরই প্রতিনিধি। ডিএসইর শেয়ারধারী কিছুসংখ্যক মালিক যেমন কখনো চান না সংস্থাটি পেশাদারত্বের সঙ্গে চলুক, তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ডিএসইতে পেশাদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি এখনো।
ডিএসইর এমডিসহ শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এ রকম সাবেক কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেশাদারত্ব নেই সংস্থাটিতে। প্রভাবশালীদের মতের বাইরে গিয়ে সেখানে কিছু করার সুযোগ কম। তাই সংস্থাটিতে পেশাদারত্ব ও স্বাধীনভাবে কাজ করা খুব দুরূহ। ডিএসইর পিয়ন থেকে শুরু করে শীর্ষ পদে স্তরে স্তরে বসানো আছে ভাইদের লোক। নিজেদের লাভে পছন্দের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো হয় ‘ভাইদের প্রিয় ভাইদের’।
একই ধরনের অবস্থা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। সংস্থাটিতে এমডি নেই প্রায় ১০ মাস। ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে সংস্থাটি চলছে এখন। সেখানেও এমডির দায়িত্ব পালন অনেকাংশে নির্ভর করে প্রভাবশালীদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ওপর।
ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী, দুই স্টক এক্সচেঞ্জের এমডির প্রথম দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে এমডির পদটিই নড়বড়ে, সেখানে কীভাবে তিনি বিনিয়োগকারী স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিনিয়োগকারীর স্বার্থে কাজ করতে হলে প্রথমেই প্রভাবশালীদের রাহুমুক্ত করতে হবে এমডিদের। কিন্তু দুই স্টক এক্সচেঞ্জই বারবার হোঁচট খাচ্ছে প্রভাবশালীদের ধাক্কায়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাও সেখানে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আর তাই ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছিল মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অধিক ক্ষমতাশালী করতে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আট বছর পর এসেও সংস্থাটি হাঁটছে সেই পুরোনো পথেই। তাহলে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের সুফল কী? এ প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।