শর্তসাপেক্ষে ৫,০০০ কোটি টাকা ঋণ পেতে পারে আইসিবি

শেয়ারবাজারগ্রাফিকস: প্রথম আলো

রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) তিন মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ চেয়ে আসছে। তাদের এই ঋণ চাওয়ার পক্ষে রয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও নিমরাজি। তবে ঋণ দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু এ নিশ্চয়তা দেবে কে? আইন অনুযায়ী তা দেওয়ার কথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের। অর্থ বিভাগ কি তা দিতে রাজি হবে?

ঢাকায় সচিবালয়ে এ নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ব্যাংক হতে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দেওয়া’ শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও আইসিবির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অন্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।

বৈঠক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আবদুর রহমান খান তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈঠক একটি হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা ও যাচাইয়ের দরকার আছে বলে আমরা মনে করছি।’

বাজারের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আইসিবি টাকাটা পেলে ভালো হবে। তখন সংস্থাটি উচ্চ সুদের ঋণগুলো ফেরত দিতে পারবে এবং বাজারে বিনিয়োগও করতে পারবে।
মো. রেজাউল করিম, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র, বিএসইসি

বৈঠক সূত্র জানায়, পাঁচ হাজার কোটি টাকার গ্যারান্টি চেয়ে অর্থ বিভাগের কাছে সুপারিশ করার আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের সম্মতি নেবে।

সূত্র আরও জানায়, আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হোসেন বৃহস্পতিবারের বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ঋণের বিপরীতে যেকোনো শর্ত প্রতিপালনে তাঁরা প্রস্তুত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব মিলে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই শর্তগুলো চূড়ান্ত করবেন।

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে আইসিবিই সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এটি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থাও। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পর বড় ধাক্কা খায় সংস্থাটি। ধসের প্রায় তিন বছর পর ২০১৩ সালে ‘পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়তা তহবিল’ গঠন করা হয়। ওই তহবিলের বড় অংশই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেয় আইসিবি। তহবিলটি অবশ্য এখন আর নেই।

দীর্ঘ সময় ধরে শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো নয়। বাজারে তারল্যসংকট চলছে। এ রকম সময়ে বড় ধরনের বিনিয়োগ সহায়তা দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে আইসিবি। একসময় সংস্থাটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মজিব উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ উচ্চ সুদে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি থেকে আমানত নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। ওই সব বিনিয়োগ করে সংস্থাটি আটকে গেছে।

আইসিবির চেয়ারম্যান সুবর্ণ বড়ুয়া গতকাল হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের দায় আইসিবিকে পোহাতে হচ্ছে। এখন টাকাটা পেলে আমরা তা যথাযথভাবে ব্যবহার করব। একটা অংশ ব্যয় হবে উচ্চ সুদের আমানত ফেরতে। আরেকট অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হবে।’

আইসিবি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আইসিবি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার মেয়াদি আমানত নিয়েছে। এর মধ্যে আট হাজার কোটি টাকার মতোই হচ্ছে উচ্চ সুদের আমানত। এ জন্য সংস্থাটিকে বছরে ৬০০ কোটি টাকার বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এদিকে আইসিবির কিছু ভুল বিনিয়োগও রয়েছে, যার পরিমাণ হাজার কোটি টাকার মতো। এ বিনিয়োগের বেশির ভাগই পদ্মা ব্যাংকসহ কিছু দুর্বল ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। মেয়াদ শেষ হলেও আইসিবি এসব বিনিয়োগ ফেরত পাচ্ছে না। শুধু মূল টাকা নয়, সুদও ফেরত পাচ্ছে না সংস্থাটি।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আইসিবি টাকাটা পেলে ভালো হবে। তখন সংস্থাটি উচ্চ সুদের ঋণগুলো ফেরত দিতে পারবে এবং বাজারে বিনিয়োগও করতে পারবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইসিবি যে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ চায়, সেটা কী? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বল্প সুদ হচ্ছে ব্যাংক রেট (হার)। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক রেট বর্তমানে ৪ শতাংশ। এ সুদেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ চায় আইসিবি। তবে সংস্থাটি দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ পাবে না। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারই আছে দেড় বছর অর্থাৎ ১ বছর ৬ মাসের জন্য ঋণ দেওয়ার। এতে প্রশ্ন উঠেছে, আইসিবি দেড় বছরের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে না পারলে কী হবে?

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হচ্ছে জনগণের। জনস্বার্থ থাকলেই সংস্থাটি তা দিতে পারে। তবে উচ্চ সুদের আমানত পরিশোধ একটা যৌক্তিক কারণ বটে। সামস্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা, ঋণ পেলেও দেড় বছরের মধ্যে কি আইসিবি ফেরত দিতে পারবে? না পারলে কী হবে, তা শর্তের মধ্যে উল্লেখ থাকতে হবে।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘এভাবে ঋণ নিয়ে সাময়িক দম দেওয়া সম্ভব হলেও দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের খুব বেশি উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। বাজারের উন্নতির চিন্তা করতে হবে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আইসিবিকে আগের ভুল বিনিয়োগের খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।’