বাজেটের পর প্রথম কর্মদিবসে শেয়ারবাজারে বড় পতন

শেয়ারবাজারগ্রাফিকস: প্রথম আলো

আবারও বড় পতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। বাজেট–পরবর্তী প্রথম কার্যদিবসে আজ রোববার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া ৮৭ শতাংশ শেয়ারের দামই কমেছে। ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৬ পয়েন্ট বা সোয়া ১ শতাংশ কমে ৫ হাজার ১৭২ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

বড় পতনের ফলে ডিএসইএক্স সূচক ৩৮ মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। এর আগে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল ৫ হাজার ১৬৫ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল এটি। বাজেট ঘোষণার পর প্রথম কার্যদিবসে শেয়ারবাজারের এই পতন আগামী অর্থবছরের বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপের কারণে ঘটেছে বলে মনে করছেন বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে শেয়ারবাজারের মূলধনি মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর নতুন করে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্রস্তাব করেন, শেয়ারবাজারে ব্যক্তিশ্রেণির কোনো বিনিয়োগকারী ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি মুনাফা করলে তার ওপর করারোপ করা হবে।

এত দিন ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মূলধনি মুনাফায় কোনো কর ছিল না।

বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ না করার জন্য শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দাবি জানিয়ে আসছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এ করারোপ করা হয়েছে। আজ লেনদেন শুরু হয়েছিল সূচকের সামান্য উত্থান দিয়ে। তবে এই ধারা বেশিক্ষণ চলেনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরপতন শুরু হয়। এরপর বেলা যত গড়িয়েছে, পতনের তীব্রতাও তত বেড়েছে।

ঢাকার মতো চট্টগ্রামের বাজারেও এদিন বড় দরপতন হয়েছে। সেখানকার সার্বিক সূচকটি ১০৬ পয়েন্ট বা পৌনে ১ শতাংশ কমেছে। তবে আগের দিনের চেয়ে লেনদেন বেড়েছে চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জে। লেনদেন হয়েছে ১০৮ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৯৪ কোটি টাকা বেশি। চট্টগ্রামে লেনদেন বাড়লেও গতকাল ঢাকার বাজারে লেনদেন কমেছে। ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৫৮ কোটি টাকা, যা আগের কার্যদিবসের চেয়ে ১৮৫ কোটি টাকা কম।

গত ফেব্রুয়ারি থেকেই শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতন চলছে। এ দরপতনের জন্য কারসাজি ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানা ভুল পদক্ষেপকে দায়ী করা হয়। দরপতনের মধ্যেও কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম কয়েক মাসে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কোম্পানি হচ্ছে লাভেলো আইসক্রিম, ইজেনারেশন, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স, ফারইস্ট নিটিং, ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রোড, গোল্ডেনসন অন্যতম। এসব কোম্পানির কয়েকটির শেয়ারের দাম গত তিন মাসে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। কারসাজির এসব শেয়ারের বিপরীতে ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ারের টানা দরপতন হয়েছে। সে কারণে বাজারে সূচকও কমে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে।

ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে এদিনও দরপতনের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল স্কয়ার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, বীকন ফার্মা, লাফার্জহোলসিম, রবি আজিয়াটা, রেনাটার মতো ভালো মৌল ভিত্তির কোম্পানির। এ ছয় কোম্পানির দরপতনের কারণে গতকাল ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে সাড়ে ১৭ পয়েন্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সূচক কমেছে স্কয়ার ফার্মার দরপতনে। গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২ টাকা ৩০ পয়সা বা ১ শতাংশের বেশি কমেছে। তাতে ডিএসইর প্রধান সূচকটি কমেছে ৬ পয়েন্টের বেশি।

বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নানা কারণে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতন হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রস্তাব বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি হতাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারের মূলধনি মুনাফায় করারোপ করা হয়েছে, তার প্রভাব সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর খুব বেশি পড়বে না। কারণ, খুব কমসংখ্যক সাধারণ বিনিয়োগকারী বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনি মুনাফা করতে পারেন। তবে এর প্রভাব বেশি পড়বে কারসাজিকারীদের ওপর। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর বেশি পড়বে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর কমানোর কারণে বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। করপোরেট করের সুবিধা নিতে আমাদের বাজারে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয় না। আবার ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন এ রকম বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও হাতে গোনা। তা সত্ত্বেও বাজেটের এসব পদক্ষেপকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী হয়তো কম দামে শেয়ার কেনার জন্য নানাভাবে ভীতি ছড়িয়ে বাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত কারসাজির ঘটনা বন্ধ ও অনিয়ম রোধে তদারকি জোরদার করা। সেখানেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।’

তবে ব্রোকারেজ হাউস–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমনিতে এক ধরনের অনীহা কাজ করছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপ সেই অনীহা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

দরপতনের মধ্যেও যে কারসাজি থেমে নেই, তার প্রমাণ মেলে দুর্বল কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনায়। গতকাল ঢাকার বাজারে মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ভিএফএস থ্রেড ডায়িং। এ কোম্পানির শেয়ারের দাম আজ ১ টাকা ২০ পয়সা বা সাড়ে ৯ শতাংশ বেড়েছে। ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানিটি গত বছর বিনিয়োগকারীদের মাত্র ২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সেন্ট্রাল ফার্মা। এটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৪ শতাংশ বা ৮০ পয়সা। অথচ কোম্পানিটি ২০১৯ সালের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো মুনাফা দেয়নি।

মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ঢাকার বাজারে এদিন লেনদেনের শীর্ষ তিন কোম্পানি ছিল লাভেলো আইসক্রিম, ফরচুন শুজ ও এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। এ তিন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের নির্বাহী বলেন, বাজার এখন কিছু কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীনির্ভর। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের হতাশা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপ বিনিয়োগকারীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।