পি কে হালদার ও পদ্মা ব্যাংকে ফেঁসে গেছে আইসিবির ৬০০ কোটি টাকা
দুর্বল মানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে ফেঁসে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। কারণ, বিপুল আমানত রেখে এখন তা ফেরত পাচ্ছে না সংস্থাটি। এমনকি ওই আমানতের বিপরীতে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে যে সুদ পাওয়ার কথা, তা–ও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনাদায়ি সুদও যোগ হচ্ছে আমানতের পরিমাণের সঙ্গে। ফলে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইসিবির আমানতের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
এ অবস্থায় এসব আমানত কবে ফেরত পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে সংস্থাটি বলছে, আমানতের বড় একটি অংশ আটকে যাওয়ায় সংস্থাটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। নিজের টাকা ফেরত না পেয়ে এখন ঋণ করতে হচ্ছে অন্যের কাছ থেকে। আবার দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ি পড়ে থাকা আমানতের বিপরীতে রাখতে হচ্ছে নিরাপত্তা–সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং। ফলে আইসিবির মুনাফায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আইসিবির সর্বশেষ ২০২১–২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন শেষে ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইসিবির স্থায়ী আমানতের (ফিক্সড ডিপোজিট) পরিমাণ ছিল ৮৮২ কোটি টাকা। যার অর্ধেকই রাখা হয়েছে আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারিতে বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই আইসিবির আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বাধিক ১৮০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে পি কে হালদারের কারণে ভয়াবহ সংকটে পড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে পদ্মা ব্যাংকে (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। যার পরিমাণ ১৪৭ কোটি টাকা। কয়েক বছর ধরেই এ দুটি প্রতিষ্ঠানে আইসিবির ৩২৭ কোটি টাকা আমানত আটকে আছে। এ আমানতের বিপরীতে নিয়মিতভাবে প্রাপ্য পুরো সুদও পাচ্ছে না সংস্থাটি। এ কারণে বছর বছর আমানতের পরিমাণ বাড়ছে। কারণ, অনাদায়ি সুদও আমানতে যুক্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা নতুন করে আর কোনো আমানত রাখছি না। কিন্তু আগে রাখা আমানত ফেরতও পাচ্ছি না। আবার সুদের পুরোটাও পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু সুদ পাওয়া যাচ্ছে, সে পরিমাণ অর্থ আমানতের পরিমাণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।’
আবুল হোসেন স্বীকার করেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের আমানত আটকে থাকায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আইসিবি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যাওয়ায় আমাদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের জন্য ঋণ করতে হচ্ছে। তাতে সুদ বাবদ আমাদের বড় অঙ্কের অর্থ লাগছে। আবার অনাদায়ি আমানতের বিপরীতে নিরাপত্তাসঞ্চিতিও রাখতে হচ্ছে। এতে টান লাগছে মুনাফায়।’
আইসিবির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও পদ্মা ব্যাংক ছাড়া সংস্থাটির বড় অঙ্কের আমানত রয়েছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স (১৪০ কোটি), ফনিক্স ফাইন্যান্সে (১৩৫ কোটি টাকা), ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে (৭০ কোটি টাকা), আভিভা (সাবেক রিলায়েন্স) ফাইন্যান্সে (৫০ কোটি টাকা), এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স (৪৯ কোটি টাকা), প্রিমিয়ার লিজিং (৪৫ কোটি টাকা), পিপলস লিজিং (২৫ কোটি টাকা) ও প্রাইম ফিন্যান্সে (৬ কোটি টাকা)। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং বহুল আলোচিত পি কে হালদারের ঋণ লুটপাটের কারণে ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় আইসিবির বড় অঙ্কের আমানত প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ ফেরত দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এদিকে দেশে ভালো মানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকার পরও দুর্বল মানের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইসিবির বিপুল পরিমাণ আমানত রাখার বিষয়টি নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ আমানতই নড়বড়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। আইসিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব আমানত রাখা হয়েছে নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে। বেশির ভাগ আমানতই রাখা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। পি কে হালদারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির আমানত নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেছেন। এ কাজের সঙ্গে আইসিবির সাবেক কিছু কর্মকর্তারও যোগসাজশ ও সহায়তা ছিল। যার ফল ভোগ করছে এখন আইসিবি।