বঙ্গবাজারে আগুন: ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই ব্যবসায় ফিরতে চান

ব্যবসায় লগ্নি করা অর্থের প্রায় সবটা হারিয়েছেন। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে কান্না ধরে রাখতে পারেননি ব্যবসায়ী তুষার হোসেন মোল্লা। গতকাল বেলা ১১টায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই পুড়ে যাওয়া দোকানের চাবির গোছা নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন তুষার হোসেন মোল্লা। ১০ বছর ধরে বঙ্গবাজারে ব্যবসা করছেন তিনি। প্রথমে অংশীদারি ব্যবসা ছিল। চার বছর আগে তুষি শাড়ি বিতান নামে নিজেই দোকান দেন। সপরিবার থাকেন বনশ্রী এলাকায়। তিন সন্তানের মধ্যে দুজন স্কুলে যায়। সব হারিয়ে নিঃস্ব তুষার হোসেনের বড় দুশ্চিন্তা সংসার আর সন্তানদের লেখাপড়ার। কিন্তু দমে যেতে চান না তিনি।

আগুনে ৯০ লাখ টাকার পোশাক পুড়ে গেছে বলে দাবি তুষার হোসেন মোল্লার। গতকাল বৃহস্পতিবার বললেন, ‘১৫ বছর আগে খালি হাতে ঢাকায় আসি। পাঁচ বছর চাকরির পর ছোট করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন আবারও সেভাবেই শুরু করতে চাই। প্রশাসনের উচিত সুযোগটা করে দেওয়া। আমাদের তো কিছুই নেই। দোকানটা ফিরে পেলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব। বাজারে ২৫ লাখ টাকা পাওনা আছে। টাকাটা পেলে ব্যবসা করা সহজ হবে। বউ–বাচ্চা নিয়ে বাঁচতে পারব।’

তুষার হোসেন মোল্লার মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী ঈদের আগেই ব্যবসায় ফিরতে চান। প্রয়োজনে পুড়ে যাওয়া বিপণিবিতানের জায়গায় খোলা আকাশের নিচেই চৌকি বসিয়ে কেনাবেচা করতে চান তাঁরা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়ে গেলেও বঙ্গবাজার এলাকা ছাড়ছেন না ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।

বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের আগে দুই সপ্তাহ ব্যবসা করতে পারলেও কিছুটা পুঁজির জোগান হবে। সেই পুঁজি দিয়ে আগামী দিনগুলোতে ব্যবসার চাকা কোনোরকমে ঘোরাতে পারবেন। এ জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

গত মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েকটি বিপণিবিতানে। সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও বুধবার এনেক্সকো টাওয়ারে থেমে থেমে ধোঁয়া ও আগুন জ্বলে। গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের কিছু জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ফলে আগের দুই দিনের মতো গতকালও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করেন।

আরও পড়ুন

ঈদের বেচাবিক্রির মৌসুমে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন থাকায় নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, নরসিংদীর বাবুরহাট, সদরঘাটের পাইকারি বাজারের অনেক ব্যবসায়ী অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। প্রতিবছরের মতো এবারও তাঁরা লাখ লাখ টাকার পণ্য বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে বাকিতে বিক্রি করেছেন।

খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ঢাকা অভিধান বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনকে কেন্দ্র করে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মধ্যভাগে বর্তমান বঙ্গবাজার এলাকায় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। হকাররা ছোট ছোট দোকানে জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। সত্তরের দশকে এখানে হকার্স মার্কেট গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এই বিপণিবিতান তৈরি পোশাকের বাজার হিসেবে জনপ্রিয় হয়। নব্বইয়ের দশকে বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী অবকাঠামোর এই বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তারপর আবারও মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের বিপণিবিতানগুলোর ভেতরটা ছিল ঘিঞ্জি। সরু গলি ও ছোট ছোট দোকানে কেনাবেচা করতেন ব্যবসায়ীরা। পাইকারি–খুচরা দুইভাবেই বেচাকেনা হতো। তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স চার বছর আগে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস।

আরও পড়ুন

ঘুরে দাঁড়াতে চান ব্যবসায়ীরা

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কয়েকজন সহায়তার দাবিতে গতকাল একাধিকবার ধ্বংসস্তূপের সামনে ব্যানার হাতে মানববন্ধন করার চেষ্টা করেন। প্রতিবারই পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়। পরে ব্যবসায়ীরা উড়ালসড়কের নিচে গিয়ে জড়ো হন।

বঙ্গবাজারের তোহায়া ফ্যাশনের মালিক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশেই আমাদের ক্রেতা আছে। তাঁদের অনেকে যোগাযোগ করছেন। ব্যবসা করার সুযোগ পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। বাজারে আমার বাকি পড়ে আছে ১৫ লাখ টাকা। এই টাকা ফেরত নিতে হলেও আমাকে ব্যবসায় টিকে থাকতে হবে।’

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের দুই দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন, ‘ঈদের আগে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা যেন সাময়িকভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা করা হবে।’

আরও পড়ুন

সালমান এফ রহমান বলেন, ‘বঙ্গবাজার মার্কেট স্থাপন নিয়ে ব্যবসায়ীরা মামলা করে রেখেছেন। এই মামলা প্রত্যাহার করা হলে নতুনভাবে মার্কেট করার ব্যাপারে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, এই ঘটনার জন্য তিনিও ব্যথিত। তাঁর তহবিল থেকেও সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী)।’

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি ও বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকেও সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ জন্য আইএফআইসি ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা হয়েছে। এখানে জমা হওয়া অর্থ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেওয়া হবে বলে জানান দোকান মালিক সমিতির নেতারা।

আরও পড়ুন

অনিশ্চয়তায় অন্য বাজারের পাইকারেরা

নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, বাবুরহাট, সদরঘাটসহ অন্যান্য পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পোশাক আসে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকানগুলোতে। ঈদের আগে সাধারণ সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি পোশাক আনেন ব্যবসায়ীরা। সেই পোশাকের দামের একটি অংশ নগদে দিলেও বড় অংশ বকেয়া থাকে। ঈদের বেচাকেনা শেষ হলে সেই বকেয়া পরিশোধ হয়।

জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারের পাশাপাশি গাজীপুর-সাভারের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার স্টক লটের পণ্যও বঙ্গবাজারে আসে। এমনকি ভারতের ব্যবসায়ীরাও পোশাক সরবরাহ করেন আমাদের।’

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর গত তিন দিনে ৮-১০ জন ব্যবসায়ী আমাদের জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁদের টাকা আটকা আছে। সংখ্যাটি অনেক বেশি হবে। আমাদের ৩০০-৪০০ ব্যবসায়ীর টাকা আটকা থাকতে পারে। এই টাকা না পেলে কেরানীগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে যাবেন। কারণ, তাঁরাও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী।’

শেখেরচর বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান ও নারায়ণগঞ্জের বাংলাদেশ হোসিয়ারি সমিতির সভাপতি নাজমুল আলম জানান, নরসিংদীর বাবুরহাট এবং নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি ও দেওভোগ এলাকার অনেক পাইকার বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করেন। তাঁদেরও বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া আছে।

আবার বঙ্গবাজারের কিছু ব্যবসায়ীর নিজেদের ছোট কারখানাও আছে আশপাশের এলাকায়। সারা বছরই এসব কারখানায় পোশাক তৈরি হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এসব কারখানার শ্রমিকদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ হাজার দোকান পুড়েছে। দোকানপ্রতি ২৫ লাখ টাকার পণ্য পুড়লেও ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এমন তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অনুমান, ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো হবে। ইতিমধ্যে ২ হাজার ৯১৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। আরও নাম আসবে। পরবর্তী সময়ে তাঁদের কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তথ্যও নেওয়া হবে।’

হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘সালমান এফ রহমান বঙ্গবাজার পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, শুক্রবার থেকে আগুনে পোড়া জায়গা পরিষ্কার করা হবে। পরশু শনিবার থেকে এখানে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীরা বসতে পারবেন। যেসব ব্যবসায়ী আগে এখানে ব্যবসা করতেন, শুধু তাঁরাই এখানে ব্যবসা করতে পারবেন।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোনরসিংদী, কেরানীগঞ্জনারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি]