ড্যাপ কেন আবাসনের জন্য চাপ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তৈরি নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ গত বছরের আগস্টে কার্যকর হয়। শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতারা মনে করেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক এবং অস্পষ্ট।
ঢাকা মহানগর দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও শহরটিতে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশের বসবাস। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) তৈরি করেছে। এটি কার্যকর হয় গত বছরের আগস্ট থেকে। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই মহাপরিকল্পনা করা হয়। যদিও শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে।
ড্যাপের খসড়া পরিকল্পনায় জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এ জন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা তীব্র সমালোচনা করেন। পরে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে এসে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করে রাজউক। এতে ধানমন্ডি ও গুলশানের মতো পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্যান্য এলাকায় ভবনের আয়তন কমে যায়। তখন আবার সমালোচনা হলে কিছু জায়গায় সংশোধন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে রাজউক। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা ড্যাপ সংশোধনের দাবি তোলেন। তাঁরা বলেন, ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য পৃথকভাবে ভবন নির্মাণের যে এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় এমনটি করা হয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ এলাকায় আগে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, সে তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জমির মালিক ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন। শুধু তাই নয়, আশপাশের খাল-বিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতারাও ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানান। তাঁরা বলেন, ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতার কারণে নতুন ভবনের নকশা অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলার সময় রাজউকের অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে সময়ক্ষেপণ, বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি। সর্বোপরি, জমির মালিক তথা জনসাধারণের অযাচিত হয়রানি বেড়েছে।
নতুন ড্যাপে মিরপুর ১০ ও ১১, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, বাড্ডা, কুড়িল, খিলক্ষেত, নিকেতন, নয়াটোলা, মধুবাগ, গোড়ান, সিপাহীবাগ, মধ্য বাসাবো, আনসারাবাদ, সবুজবাগ, কদমতলা, দক্ষিণগাঁও, মালিবাগ, শান্তিবাগ, শুক্রাবাদ, পশ্চিম রাজাবাজার ও জিগাতলার মতো এলাকায় এফএআর কম দেওয়া হয়েছে। অবশ্য কোনো জমি প্লট আকারে ভাগ না করে একসঙ্গে ‘ব্লক’ তৈরি করে ভবন নির্মাণ করলে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডির মতো এলাকায় এফএআর বেশি। সাধারণত যেসব এলাকায় যত বেশি এফএআর, সেখানে ভবনের আয়তন তত বেশি পাওয়া যায়। এ ছাড়া আয়তনের সঙ্গে ভবনের উচ্চতা কিংবা ফ্ল্যাট সংখ্যার বিষয়টিও জড়িত।
এদিকে নতুন ড্যাপের কারণে আবাসন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে জমির মালিকেরা ভবন করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। নতুন প্রকল্পও নেওয়ার হার কমেছে। ড্যাপ সংশোধন না হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাবে। এমনকি বিভিন্ন এলাকায় ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কম দামের ফ্ল্যাট কেনার সুযোগটি হারাবেন নগরবাসী।
রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণের অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। নতুন ড্যাপের আলোকে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা করার প্রক্রিয়াটি বর্তমানে চলমান।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রস্তাবিত বিধিমালা সংশোধনের একগুচ্ছ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে রাজউকে দিয়েছে। এতে প্লট–সংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততা সংশ্লিষ্ট অনুমোদনযোগ্য এফএআর সূচক এবং এলাকাভিত্তিক এফএআর বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তারা। সেটি বাস্তবায়িত হলে বর্তমানের মতো একই আয়তনের ভবন নির্মাণের সুযোগ তৈরি হবে।
জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ড্যাপ বাতিল চেয়েছিলাম। তবে সেটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে প্রস্তাবিত ইমারত বিধিমালায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। আমরা ভবনের আয়তন বাড়ানোর পাশাপাশি রাস্তা কমপক্ষে ২০ ফুট করার প্রস্তাব দিয়েছি। ভবনের ওকুপেন্সি সনদ নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি শহরকে পরিবেশবান্ধব ও জলাবদ্ধতা নিরসনের সুপারিশ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ঢাকাবাসী, জমির মালিক, ফ্ল্যাটের ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সবার ভালোর জন্যই ড্যাপ সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
অবশ্য স্থপতিদের কেউ কেউ বলছেন, যে এলাকার রাস্তা সংকীর্ণ, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়, খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত অঞ্চল নেই, কাছে–পিঠে স্কুল বা হাসপাতাল নেই, সেসব জায়গায় যদি সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আরও বেশি মানুষ সেখানে বসবাস করবে। বিদ্যমান যে অবকাঠামো, তার ওপর আরও বেশি চাপ পড়বে।
ড্যাপ নিয়ে কিছু কথা
১৯৫৩ সালের ‘টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের’ আওতায় ২০১০ সালে প্রথম ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়। পাসের পর আবাসন ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীদের চাপে সেটি চূড়ান্ত করতে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠনে বাধ্য হয় সরকার। ওই কমিটি ড্যাপ চূড়ান্ত না করে উল্টো দুই শতাধিক সংশোধনী আনে। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত জলাভূমি ভরাটের বৈধতা দেওয়া হয়। প্রথম ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়।
রাজউক ২০২০ সালে দ্বিতীয় ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) খসড়া প্রকাশ করে। গত বছরের আগস্টে পাস হওয়া এই ড্যাপ ছয়টি স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয় অঞ্চল: ঢাকা শহর, উত্তর অঞ্চল: গাজীপুর সিটি করপোরেশন, পূর্ব অঞ্চল: কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণ অঞ্চল: নারায়ণগঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল: কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিম অঞ্চল: সাভার উপজেলা।
নতুন ড্যাপে ৫৪৭ কিলোমিটার জলপথকে ‘নগর জীবনরেখা’ আঙ্গিকে নতুনভাবে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবান্ধব অবকাঠামো, বিনোদনের স্থান, পরিবেশবান্ধব হাঁটার পথ, জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি সুবিধা থাকবে। প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে আঞ্চলিক পার্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬২৭টি বিদ্যালয় ও ২৮৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রস্তাব করেছে ড্যাপ।
ভবনের আয়তন বাড়ানোয় জোর
নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে (ওয়ার্ড-৩১) ২০ ফুট সড়কের পাশের প্লটের এফএআর ২ দশমিক ৭৫। আর এলাকাভিত্তিক এফএআর ২ দশমিক ৩। সেখানকার কাঠাপ্রতি জনঘনত্ব ১ দশমিক ৯। ফলে ৫ কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ২৮০ বর্গফুট আয়তনের ভবন করা যাবে। ফ্ল্যাট করা যাবে ৯-১০টি।
প্রস্তাবিত ইমারত বিধিমালায় রিহ্যাব যে প্রস্তাব করেছে, সেটি বাস্তবায়িত হলে মোহাম্মদপুরের ওই ওয়ার্ডে ২০ ফুট সড়কের পাশের প্লটের এফএআর ৪ দশমিক ২৫, আর এলাকাভিত্তিক এফএআর ৪ দশমিক ০৪ হবে। সেখানকার কাঠাপ্রতি জনঘনত্ব ২ দশমিক ৮৯। ফলে ৫ কাঠা জমিতে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫৪৪ বর্গফুট আয়তনের ভবন নির্মাণ করা যাবে। তখন ফ্ল্যাট হবে ১৪-১৫টি।
আবার নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর সেকশনে ১৬ ফুটের বেশি ও ২০ ফুটের কম এমন সড়কের পাশের ৩ কাঠা প্লটে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮৬০ বর্গফুট আয়তনের ভবন নির্মাণ করা যাবে। তার মানে, ভবন হবে ২-৩ তলা। প্রস্তাবিত ইমারত বিধিমালায় রিহ্যাব এই এলাকার জন্য বেশি এফএআর চেয়েছে। সেটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে ৮ হাজার ১০০ বর্গফুট আয়তনের ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলবে। আর সর্বোচ্চ ফ্ল্যাট করা যাবে ৯টি। অর্থাৎ একই জায়গায় ৩ হাজার ২৪০ বর্গফুট বা ৪টি ফ্ল্যাট বেশি নির্মাণ করা যাবে।
এ ছাড়া বৃষ্টির পানি শোষণের জন্য প্লটভেদে ভূমি আচ্ছাদন ও অনাচ্ছাদিত স্থানেও পরিবর্তন চেয়েছে রিহ্যাব। যেমন ড্যাপে বলা হয়েছে, ২ কাঠা বা তার কম পরিমাণ জমিতে সর্বোচ্চ ৭০ ও সর্বনিম্ন ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ ভূমি আচ্ছাদন থাকবে। রিহ্যাব সব জমির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভূমি আচ্ছাদনের বিষয়টি তুলে দিতে সুপারিশ করেছে।
ভবনের আয়তন বাড়ানো হলে ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনের বেশি আয়তন বা উচ্চতা দিলে ঢাকা আরও বেশি বাসযোগ্য হবে। অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার দোহাই দিয়ে অনেক এলাকায় ভবনের আয়তন কম দেওয়াটা অযৌক্তিক। কারণ, এতে ঢাকার আশপাশের খাল–বিল ও জলাশয় ভরাটের প্রবণতা বাড়বে। তাতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে সব দিক বিবেচনা নিয়ে আমরা ভবনের আয়তন বাড়ানোসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছি।’