ডলার–সংকটের প্রভাব কৃষিযন্ত্রের বাজারে

এখন কৃষিতে মাড়াই, রোপণসহ সব ধরনের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্র। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার, এ জন্য যন্ত্রভেদে ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিও দিচ্ছে। ফলে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন কোম্পানিও।

বাংলাদেশের কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর যন্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়ে। ওই সময়ে চাষের জন্য পাওয়ার টিলারের ব্যবহার বেড়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে পাওয়ার টিলারের পরিবর্তে ট্রাক্টরের ব্যবহার শুরু হয়। পাশাপাশি এখন কৃষিতে মাড়াই, রোপণসহ সব ধরনের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্র। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার, এ জন্য যন্ত্রভেদে ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিও দিচ্ছে। ফলে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন কোম্পানিও।

তবে গত বছর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে শুরু হয় ডলারের সংকট। এরপর ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, এসবের দামও বেড়ে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর প্রভাব পড়ছে পুরো কৃষি খাতে।

কৃষিযন্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্য, তেল ও গ্যাস আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ডলার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কৃষিযন্ত্র আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ডলার দিচ্ছে না। এদিকে কারও নজরও নেই। কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়লে খাদ্য উৎপাদনও বাড়ত। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকত বাংলাদেশ।

দেশে যেসব কোম্পানি কৃষিযন্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো এসিআই, মেটাল, কর্ণফুলী, র‍্যাংকন, আবেদিন, গেটকো, আলীম, এসকিউ, বাংলামার্ক ও ইয়ন গ্রুপ।

মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২২ সালে ভালো ব্যবসা হলেও এখন চাহিদা কমে গেছে। কারণ, ডলারের কারণে যন্ত্রের দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। তেলের দামও বেড়েছে। ফলে কৃষিযন্ত্রের ব্যবসা কমে গেছে। এ ছাড়া আমরা যন্ত্র আমদানিতে চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। ব্যাংকগুলোও মার্জিনের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা কমে যাচ্ছে।’

চাষ ও কাটার যন্ত্রের বাজার

একসময় কৃষিতে ব্যবহৃত হওয়া পাওয়ার টিলারের ব্যবহার এখন খুবই কম। কারণ, পাওয়ার টিলার সব ধরনের জমিতে যথাযথ চাষের জন্য উপযোগী ছিল না। এর পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। পাশাপাশি জেলা ও উপজেলাগুলায় মালামাল পরিবহনেও ট্রাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে। একসময় ট্রাক্টর কেনার ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিত। তবে এখন আর দেওয়া হয় না। কারণ, কৃষির পাশাপাশি ট্রাক্টরের বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। আর ট্রাক্টরের এই বহুমুখী ব্যবহারের কারণে এর বিক্রিও বাড়ছে।

ট্রাক্টর বিক্রির সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে ২০২০ সালে দেশে ট্রাক্টর বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৬৯৩টি। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ৮ হাজার ৫৫৬টি। ডলার–সংকটের কারণের গত বছর তা কমে হয় ৭ হাজার ৬৭৬টি। আর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ট্রাক্টর বিক্রি কমে হয়েছে ৫ হাজার ২০০টি।

এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সরবরাহ কম, দামও বেড়ে গেছে। চলতি বছরের বাকি সময়ে যে পরিমাণ ট্রাক্টর বিক্রি হবে, তাতে মোট বিক্রি গত বছরের তুলনায় কমই থাকবে।

ট্রাক্টরের পরেই কৃষিযন্ত্রের বড় বাজার কম্বাইন হারভেস্টারের, যা ধান ও গম কাটার কাজে ব্যবহার করা হয়। সরকার এখন এই যন্ত্রে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। আর হাওর অঞ্চলের এই যন্ত্র বিক্রিতে দেওয়া হচ্ছে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি। ফলে কৃষিতে এই যন্ত্রের ব্যবহার দ্রত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক সময় কৃষকেরা কয়েকজন মিলে এই যন্ত্র কিনছেন, আবার শিক্ষিত তরুণেরাও এই যন্ত্র কিনে উদ্যাক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছেন। ফলে গ্রামগুলোয় নতুন একটি উদ্যোক্তা শ্রেণিও গড়ে উঠছে।

সরকারি হিসাবে, ২০২০ সালে কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রি হয়েছিল ৮৫০টি, ২০২১ সালে যা তিন গুণের বেশি বেড়ে হয় ২ হাজার ৭৫০টি। ২০২২ সালেও এই যন্ত্রের বিক্রি বাড়ে, বিক্রি হয় ৩ হাজার ৯৪২টি। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বিক্রি কমে হয় ২ হাজার ৫০০টি।

বাজার করপোরেটদের হাতে

কৃষিযন্ত্র দেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যবহার হলেও এই বাজার পুরোপুরি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। ট্রাক্টরের বাজারের মেটাল গ্রুপ ও এসিআই কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। দুটি ব্যবসায়ী গ্রুপ মিলেই ৬০-৭০ শতাংশ ট্রাক্টর বিক্রি করছে। মেটাল গ্রুপ ট্যাফে ও আইশার ট্রাক্টর বাজারজাত করছে, অন্যদিকে এসিআই করছে সোনালিকা।

২০২২ সালে বিক্রি হওয়া ৭ হাজার ৬৭৬টি ট্রাক্টরের মধ্যে মেটাল একাই বিক্রি করেছে ২ হাজার ৭১৬টি। এরপর এসিআই ২ হাজার ৪৪৪টি, কর্ণফুলী ১ হাজার ১০৭টি, র‍্যাংকন ৩৯৫টি, আবেদিন ইকুইপমেন্ট ৪১৩টি, এসকিউ গ্রুপ ২০৯টি, ইয়ন গ্রুপ ১৭৩টি ও গেটকো ১০২টি ট্রাক্টর বিক্রি করেছে।

তবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বিক্রি হওয়া ৫ হাজার ২০০টি ট্রাক্টরের মধ্যে এসিআই একাই বিক্রি করেছে ১ হাজার ৮৫৭টি। তাদের পরে যারা আছে, তারা হলো মেটাল ১ হাজার ৫০০টি, কর্ণফুলী ৭৯৩টি, র‍৵াংকন ১৮৬টি, আবেদিন ইকুইপমেন্ট ৩৬৭টি, এসকিউ গ্রুপ ২৯৪টি, ইয়ন গ্রুপ ৬২টি, গেটকো ৪৮টি।

আর কম্বাইন হারভেস্টারের বাজারে শীর্ষে রয়েছে রয়েছে এসিআই। তারা ইয়ানমার ব্র্যান্ডের যন্ত্র বিক্রি করে। এরপরই কুবোটা ব্র্যান্ডের যন্ত্র নিয়ে পরের অবস্থানে আছে আবেদিন ইকুইপমেন্ট, এফ ওয়ার্ল্ড ব্র্যান্ডের যন্ত্র নিয়ে মেটাল গ্রুপ। এরপরই ধান ও গম কাটা যন্ত্র বেশি বিক্রি করছে এসকিউ গ্রুপ, বাংলামার্ক, আলীমসহ আরও কিছু কোম্পানি।

এসিআই মোটরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষিযন্ত্রের দাম ৩০ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। আবার ঋণপত্র খুলতে আগের ৪৮ ঘণ্টার জায়গায় এখন ৪৮ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিক্রি কিছুটা কমেছে। এ জন্য আমরা ট্রাক্টর কেনার কিস্তির সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছি। এককালীন জমাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

আসছে বিদেশি বিনিয়োগ

বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনে বড় বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ৯টি বিদেশি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানি জাপানের, দুটি কোরিয়ার ও একটি তাইওয়ানের। এ ছাড়া বাকিগুলো চীনের বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এসব কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিই বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের জন্য জায়গা বরাদ্দ চেয়েছে। আর বাকি চারটি রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কারখানা তৈরি করতে চায়।

কৃষি খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বার্ষিক বাজার প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার। কৃষিতে ব্যবহ্রত হয়, এমন বড় যন্ত্রের বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ে অল্প কিছু যন্ত্র এখন তৈরি হচ্ছে। নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসলে দেশেই তৈরি হবে এসব যন্ত্র, যা বিদেশে রপ্তানিও হতে পারে।