উৎপাদন ব্যাহত
কাঁচা মরিচের দাম কবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে
আমদানি কম হচ্ছে, দেশেও এখন উৎপাদন সীমিত। সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকায় বাজারে কাঁচা মরিচের দাম পুরোপুরি কমছে না।
মাসখানেক আগে হঠাৎই কাঁচা মরিচের ঝাঁজ বাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম ৭০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয়। কোরবানির ঈদের পর আমদানি শুরু হলে দাম কমে আসে। তবে দাম এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত ও ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচ বাজারে আসছে। তারপরও দাম স্বাভাবিক হচ্ছে না। কবে দাম স্বাভাবিক হবে, সেই ধারণাও দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে আরও কিছুদিন ভোক্তাদের যে বেশি দামেই কাঁচা মরিচ কিনতে হবে, সেটি প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখনো কাঁচা মরিচের সরবরাহ কম। ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচের দামও বেশি পড়ছে। সে জন্য অনেকেই নিয়মিত আমদানি করছে না। ফলে দাম পুরোপুরি স্বাভাবিক হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষকেরা বলছেন, খরার কারণে মে-জুন মাসে দেশে মরিচের আবাদ ভালো হয়নি। মাঝে অতিবৃষ্টির কারণেও আবার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
গত চার বছরের বাজার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট মাসে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম থাকে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। দু–একবার দেশের কোথাও কোথাও প্রতি কেজির দাম ৩০০ বা ৪০০ টাকায় ওঠার রেকর্ড হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু এবার প্রতি কেজির দাম সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। গত সপ্তাহেও রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে মানভেদে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ২৪০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজারে দেশি মরিচের কেজি ১২০–১৩০ টাকা এবং ভারতীয় মরিচের কেজি ১৫০–১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাজারে কাঁচা মরিচের দাম ওঠানামা করছে। ভারতেও দামের তাল নেই। আবার মৌসুমি আমদানিকারকেরা এসে বাজার নষ্ট করছেন। এই অবস্থায় আমদানি করলে লোকসান হতে পারে ভেবে অনেক বড় ব্যবসায়ী বিরত রয়েছেন।
কেন আমদানি কম
কোরবানির ঈদের আগে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম যখন বাড়তে বাড়তে ১৫০,২০০ ও ২৫০ টাকা কেজি হয়, তখনো কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। প্রতি কেজি ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে ২৫ জুন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিতে শুরু করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর গত এক মাসে (২৪ জুলাই পর্যন্ত) সরকার মোট ৬০ হাজার ১২৫ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৮৯৩ টন আমদানি হয়েছে। এর মানে অনুমতির মাত্র ৫ শতাংশের মতো কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে।
দেশে মরিচের দাম এখনো বেশি। তারপরও ব্যবসায়ীরা কেন আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এমন প্রশ্ন করা হলে আমদানিকারকেরা প্রথম আলোকে জানান, অন্যবারের তুলনায় ভারতে এবার কাঁচা মরিচের দাম বেশি। আবার দেশে ডলারের দাম চড়া। এর ওপর পরিবহন ও শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। ফলে কাঁচা মরিচ আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে।
ঢাকার শ্যামবাজারের মরিচ আমদানিকারক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে কাঁচা মরিচের দাম ওঠানামা করছে। ভারতেও দামের তাল নেই। আবার মৌসুমি আমদানিকারকেরা এসে বাজার নষ্ট করছেন। এই অবস্থায় আমদানি করলে লোকসান হতে পারে ভেবে অনেক বড় ব্যবসায়ী বিরত রয়েছেন। আমি নিজেও এক সপ্তাহ ধরে মরিচ আমদানি করিনি।’
দেশে ফলনের যে অবস্থা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এখন মাগুরা, ফরিদপুর, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, রাজশাহী, নীলফামারী, ডোমার, পঞ্চগড়, পাবনা, জামালপুর, লালমনিরহাট প্রভৃতি এলাকায় দেশীয় জাতের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল মরিচের চাষ হয়। এর মধ্যে শীতকালে বারি মরিচ-৪ ও ৩, আর গ্রীষ্মকালে বারি মরিচ-৩–এর আবাদা হয়। এই দুই মৌসুমে কাঁচা মরিচের ব্যাপক চাষাবাদ হয়। বর্ষাকালে মরিচের আবাদ কমে যায়। এই সময়ে বারি মরিচ-২ চাষ হয়, যা কিছুটা বৃষ্টিসহিষ্ণু।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে কাঁচা মরিচ উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৯২ হাজার টন। এর আগের বছরে ৫ লাখ ৭৬ হাজার টন উৎপাদন হয়।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, এবার এই উপজেলায় কমবেশি ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। কিন্তু খরার কারণে ফলন ভালো হয়নি। এখন মৌসুম শেষ হয়ে এসেছে। কিছুদিনের মধ্যে মরিচগাছ তুলে ফেলা হবে। এরপর সেভাবে আর মরিচের আবাদ হবে না।
এরপরের দফায় রবিশস্যের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবার আবাদ হবে। তবে বাজারে নতুন মৌসুমের কাঁচা মরিচ উঠতে শুরু করবে নভেম্বর থেকে। তখন মরিচের সরবরাহ বাড়বে, দাম কমবে। তার আগপর্যন্ত মোটাদাগে আমদানি করা কাঁচা মরিচের ওপর নির্ভর করতে হবে। দেশীয় কাঁচা মরিচও পাওয়া যাবে কিছু।
বিপর্যয় এড়াতে করণীয়
এবার রাজধানীর বাজারে কাঁচা মরিচের দাম শুধু বাড়তিই না, বেশ ওঠানামাও করছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা, বাড়ির আশপাশে বা ছাদে চাষাবাদ এবং বৃষ্টি ও খরা সহনশীল কাঁচা মরিচের জাত উদ্ভাবনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নুর আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমের উপযোগী কাঁচা মরিচের জাত উদ্ভাবনের জন্য আমাদের গবেষণা চলছে। আর এবার যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে কাঁচা মরিচের ক্ষতি বেশি হয়েছে, তাই আমরা গরমসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের কথাও চিন্তাভাবনা করছি।’
কাঁচা মরিচের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সময়ে কী পরিমাণ মরিচ আমাদের দরকার হয়, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আর আমদানির অনুমতি দিতে হলে দেশীয় উৎপাদনের সঙ্গে সংগতি রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কৃষকের ওপর কোনো চাপ তৈরি করা যাবে না। বাজার ব্যবস্থাপনা হতে হবে পরিচ্ছন্ন। তাতে সংকটের সম্ভাবনা কমবে।’