হল-মার্কের সম্পত্তি টুকরা করে বিক্রি হবে, যেসব সম্পত্তি এখন সোনালী ব্যাংকের আয়ত্তে
আপাতত বড় ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হল–মার্কের শিল্পপ্লট ও রোকেয়া সরণির বাড়ি ভাগ করে বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে সোনালী ব্যাংক।
বহুল আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারি–সংক্রান্ত একটি ফৌজদারি মামলার রায় হয়েছে গত ১৯ মার্চ। বাকি মামলাগুলো শুনানির পর্যায়ে আছে। এগুলোর রায় কবে হবে, তা বলা কঠিন। তবে আদালতের দেওয়া ওই রায়ের সুবাদে হল-মার্ক গ্রুপের বন্ধকি সম্পত্তিগুলো বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে সোনালী ব্যাংক।
হল-মার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে করে, গ্রুপটির সব সম্পত্তি বর্তমানে তাদের দখলে আছে। সেগুলো বিক্রি করতে পারলে গ্রুপটির কাছে তাদের মোট পাওনার অন্তত কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
কিন্তু কে কিনবে হল-মার্কের সম্পত্তি? অনেকেই সরেজমিনে জায়গা দেখতে আসছেন। তবে সম্পত্তির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ফিরে যাচ্ছেন। সে জন্য সোনালী ব্যাংক এখন হল–মার্কের সাভারের শিল্পপ্লটগুলো ছোট ছোট আকারে ভাগ করে বিক্রির চিন্তা করছে। এ ছাড়া ঢাকার কাফরুল মৌজার আওতাধীন রোকেয়া সরণিতে ১০০ শতাংশের বেশি জায়গা রয়েছে গ্রুপটির। সোনালী ব্যাংকের বিবেচনায় এটাই সবচেয়ে দামি সম্পত্তি। এটাও কয়েক টুকরা করে বিক্রির উদ্যোগ রয়েছে ব্যাংকের।
সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক যদি লোকসান কমিয়ে আনতে পারে, তা সমর্থন করা উচিত। এখন তো সম্পত্তিগুলো পড়ে আছে। বিক্রি করা গেলে এগুলো কোনো না কোনো কাজে লাগবে, যা অর্থনীতির স্বার্থের জন্য ইতিবাচক হবে।জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়
শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের এক বৈঠকে হল–মার্কের সম্পত্তি টুকরো টুকরো করে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আফজাল করিম। তিনি প্রথম আলোকে জানান, মামলা চলমান। তবে অর্থ উদ্ধারে তাঁরা নতুন কিছু উদ্যোগ নিচ্ছেন।
বিশদ জানতে চাইলে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাস চন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন এমডি আফজাল করিম। আবার সুভাস চন্দ্র দাস পরামর্শ দেন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
জিএম আবদুল কুদ্দুস সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হল-মার্কের সম্পত্তি বিক্রি করার পথে আছি। কিছু সম্পত্তির নামজারি ছিল না, এগুলো করা হচ্ছে। কিছু সম্পত্তির খাজনা বাকি ছিল, এগুলোও দেওয়া হচ্ছে। বিক্রির জন্য সম্পত্তি নিষ্কণ্টক করার কাজগুলো এখন চলছে। আর খোঁজা হচ্ছে সম্ভাব্য ক্রেতা।’ নিষ্কণ্টক করার পর অর্থঋণ আদালত আইনের ৩৩(৭) ধারা অনুযায়ী এগুলো বিক্রির জন্য নিলাম ডাকার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
সোনালী ব্যাংকের এ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল রূপসী বাংলা (বর্তমানে ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখায়। বর্তমানে শাখাটির ডিজিএম মো. আনিসুজ্জামান। তিনিও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–১ গত ১৯ মার্চ এক মামলার রায়ে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির হোতা গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ ও চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ অন্য আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এরপরই গ্রুপটির সম্পত্তিগুলোর এখন কী অবস্থা, সেই আলোচনা সামনে চলে আসে। মাঝখানে হল-মার্ক গ্রুপের ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ করেছে সোনালী ব্যাংক। এ থেকে টাকা আদায় হয়নি।
সাভারের হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কের তেঁতুলঝোড়া ব্রিজের পশ্চিমে ১ হাজার ৩০০ শতাংশ জমিতে হল-মার্কের একটি শিল্পপার্ক রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে সারি সারি পাকা দেয়ালে টিনশেড ও বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। তবে অধিকাংশ ভবনই ফাঁকা ও পরিত্যক্ত।
কী করেছিল হল-মার্ক গ্রুপ
হল-মার্ক গ্রুপ কারসাজির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন রূপসী বাংলা শাখা থেকে মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা বের করে নিয়ে গিয়েছিল। শাখাটির আমানতের পরিমাণই যেখানে ৬০৯ কোটি টাকা, সেখানে এক হল-মার্ককেই দেওয়া হয়েছিল এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি টাকা। অন্য শাখা থেকে টাকা এনে প্রধান কার্যালয়ই এ অর্থের জোগান দেয়। তখন ব্যাংকের এমডি ছিলেন হুমায়ুন কবির, যিনি এখন পলাতক।
অভিযোগ আছে, হল-মার্ক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যবহার করে টাকা বের করে নিয়েছে। অর্থনীতি বা ব্যাংকিংয়ের কোনো কিছুর সঙ্গে যোগসূত্র না থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী হল-মার্কের পক্ষে ব্যাংকের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন। গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১২ সালের মাঝামাঝি এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার কর্মকর্তা সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী প্রায়ই ওই শাখায় যাতায়াত করতেন। যদিও দুদক সামাজিক সম্পর্কের কথা বলে মোদাচ্ছের আলীকে দায়মুক্তি দেয়। দায়মুক্তি দেয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও। ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ীই ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নিতে হল-মার্ক ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে, যেগুলোর বেশির ভাগই ভুয়া বা নামসর্বস্ব।
মামলা, সম্পত্তি ও আদায়
অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর তানভীর মাহমুদ ও জেসমিন ইসলামদের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ অভিযোগপত্র গঠিত হয়। শুনানি ও সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে এ মামলারই রায় হয়েছে গত ১৯ মার্চ।
এটিসহ দুদকের ফৌজদারি মামলা ছিল ১৭টি। এক কোটি টাকা সমন্বয়ের মাধ্যমে হল-মার্ক প্যাকেজিংয়ের বিরুদ্ধে করা মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আরও এক কোটি টাকা সমন্বয়ের মাধ্যমে ফারহান ফ্যাশনও মামলা থেকে শিগগিরই বাদ যাবে। বাকি থাকবে ১৫টি মামলা।
এদিকে অর্থঋণ আদালতে ১৭টি মামলার রায় ব্যাংকের পক্ষে এসেছে। আদালতের চূড়ান্ত রায় নিয়ে ব্যাংক এখন সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলাম করার পথে রয়েছে। অন্যদিকে আছে ৩২টি মানি মোকদ্দমা, হল-মার্ক গ্রুপের পাশাপাশি সরবরাহকারী ও অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরাও এসব মামলার আসামি।
সোনালী ব্যাংক জানায়, কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর হল-মার্কের কাছ থেকে মোট ৪১০ কোটি টাকা দায় কমাতে পেরেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই দায় কমানোসহ এ পর্যন্ত ৫৮৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। কিছু সমন্বয় হয়েছে, কিছু এলসি দায় বাতিল হয়েছে এবং কিছু পার্টি (প্রতিষ্ঠান) টাকা দিয়েছে। ব্যাংকের দখলে থাকা সম্পত্তির মধ্যে ২২৫ শতাংশ জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়েছে, যা থেকে মাসে দুই–আড়াই লাখ টাকা আসে। হল-মার্কের রোকেয়া সরণির প্রধান কার্যালয় থেকে আসে আরও ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। হল-মার্ক শিল্পপার্কে বর্তমানে ১০ জন আনসার রয়েছেন, নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন আরও ২০ জন। প্রতি মাসে তাঁদের বেতনসহ প্রায় ১৭ লাখ টাকা খরচ হয়।
কত সম্পত্তি ব্যাংকের আয়ত্তে
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, হল-মার্ক কর্তৃপক্ষ ৬ হাজার ১০০ শতাংশ সম্পত্তির দলিল দিয়েছিল ব্যাংককে। এর মধ্যে সাভারের নন্দখালী, কালামপুর, বারবাড়িয়া ও চারিপাড়া মৌজায় ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ শতাংশ জমি। ব্যাংক পরে আরও জমি উদ্ধার করে। মোট জমির মধ্যে জেসমিন ইসলামের নামে ছিল ১২২ শতাংশ। এ থেকে রাজধানীর কাফরুল ও সাভারের কিছু জমি তৎকালীন কলেজপড়ুয়া ছেলে ইরফান ইসলামের নামে তিনি হেবা (দান) করে দিয়েছেন।
কাগজপত্র ঠিক না থাকায় ব্যাংক সব সম্পত্তি বন্ধক নিতে পারেনি। অর্থঋণ আদালতে জারি মামলা করার পর ২০১৭ সালে হল-মার্কের ৩ হাজার ৫১৫ শতাংশ সম্পত্তি প্রথম ব্যাংকের দখলে আসে। দ্বিতীয় জারি মামলা করার পর দখলে আসে আরও ৩ হাজার ৮৯৪ শতাংশ জমি। তৃতীয় জারি মামলা করা হয় ২০২২ সালে, যার বিপরীতে ৫ হাজার ৪৯৯ শতাংশ সম্পত্তি নতুন করে আয়ত্তে আনার জন্য ব্যাংক আদালতে আবেদন করেছে। এগুলো এখন অর্থঋণ আদালতে শুনানির পর্যায়ে আছে। এর বাইরেও কিছু সম্পত্তি আছে। এগুলো বিক্রি করা গেলে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা
এদিকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের ৮৯২ কোটি টাকা কেটে রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেই এসেছে এটা জালিয়াতি, তাই হিসাব থেকে টাকা কাটার সিদ্ধান্ত বেআইনি। এ টাকার অংশ ফেরত আনতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করে সোনালী ব্যাংক। মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাটি তদারকি করত, তাহলে এ দেশের সর্ববৃহৎ ঋণ জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটত না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অপরাধীর শাস্তি হিসেবে হল-মার্কের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত তৈরি হওয়ার দরকার ছিল। আর বিদ্যমান আইনের ধারাতেই সব সমাধানের পথ দেওয়া আছে। সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক যদি লোকসান কমিয়ে আনতে পারে, তা সমর্থন করা উচিত। এখন তো সম্পত্তিগুলো পড়ে আছে। বিক্রি করা গেলে এগুলো কোনো না কোনো কাজে লাগবে, যা অর্থনীতির স্বার্থের জন্য ইতিবাচক হবে।