রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে চান দেশের ব্যবসায়ীরা

আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদের শাসনামলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনে রাজনীতিকরণ হয়েছে। এসব সংগঠনের পদে বসেছেন সরকার-ঘনিষ্ঠ বা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের পদধারী ব্যবসায়ীরা। বিনা অপরাধে কোনো ব্যবসায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার হলেও তাঁদের পাশে দাঁড়াননি কিংবা প্রতিবাদ জানাননি ব্যবসায়ী নেতারা। ১৫ বছর ধরে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর ব্যবসায়ী নেতাদের উপলব্ধি হয়েছে, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ব্যবসায়ীদের এক হতে হবে।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আজ বুধবার বিকেলে আয়োজিত এক সম্মেলনে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা তাঁদের এমন উপলব্ধির কথা বলেন। তাঁরা বাণিজ্য সংগঠনগুলোর দলীয়করণের পেছনে রাজনীতিবিদ নয়, বরং নিজেরাই নিজেদের দায়ী করেন। ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাণিজ্য সংগঠনগুলোরও সংস্কার দাবি করেন। বলেন, ব্যাংক লুট ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমরা ব্যবসা চালাতে পারছি না। কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। বিদেশি ক্রেতারা আতঙ্কিত। তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি আমরা। ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
এ কে আজাদ, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই।

ব্যবসায়ী সমাজের ব্যানারে আয়োজিত ‘ব্যবসা–বাণিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি), বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। মঞ্চে আরও ছিলেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি কামাল উদ্দীন আহমেদ।

ব্যবসায়ী সম্মেলনে পণ্যভিত্তিক বিভিন্ন খাতের বাণিজ্য সংগঠন ও চেম্বারের বর্তমান এবং সাবেক নেতারাসহ কয়েক শ ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে দর্শক সারিতে ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, এ কে আজাদ ও জসিম উদ্দিন; স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী; ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান প্রমুখ।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একাধিক বাণিজ্য সংগঠন থেকে আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ সভাপতিদের পদত্যাগ করানো হয়েছে। ব্যবসায়ী সম্মেলন থেকেও কেউ কেউ সব বাণিজ্য সংগঠনের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি তোলেন।

সভাপতির বক্তব্যে মাহবুবুর রহমান বলেন, বাণিজ্য সংগঠনে রাজনীতিকরণ হয়েছে। এটি কমিয়ে আনতে হবে। তবে যেভাবে পর্ষদ হোক না কেন, গায়ের জোরে সংগঠনের নেতৃত্ব নেওয়া সঠিক হবে না। তাহলে ভবিষ্যতে একই ঘটনা ঘটবে। ১৫-১৬ বছর অপেক্ষা করতে পারলে ১৫ মাস কেন অপেক্ষা করতে পারবেন না। পুরো প্রক্রিয়াটি আইনের মধ্যে থেকে করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের অনেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করেন। এ বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতকে শক্তিশালী করতে না পারলে আমরা যে সংস্কার প্রত্যাশা করছি, তা অর্জিত হবে না।’ এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান আবদুল আউয়াল মিন্টু। পাশাপাশি তিনি সদস্যদের সমস্যা সমাধান করতে না পারলে বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র ও অর্থনীতি একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেব। একই সঙ্গে দাবি থাকবে, যত দ্রুত সম্ভব কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। দেশের অনেকেই সম্পদ সৃষ্টি ছাড়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। গণতন্ত্র ও জবাবদিহি ছাড়া এসব বন্ধ করা যাবে না।’

সম্মেলনে বক্তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহতদের স্মরণ করেন। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ছোট ছোট বাচ্চারা যে সুযোগ নিয়ে এসেছে, সেটার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সুন্দরভাবে দেশটা গড়ে তুলতে হবে। পেছনের ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ও সহসভাপতি কে হবেন, তা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ঠিক করে দেওয়াটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়েছে এফবিসিসিআই। সম্মেলনে কয়েকজন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি করেন। তাঁদের একজন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘ফেডারেশন থেকে মনোনীত পদ বাতিল করতে হবে। বর্তমান পর্ষদের ওপর অনাস্থা জানাই। অবিলম্বে পদত্যাগ করুন।’ তাঁর এই বক্তব্যের সময় এফবিসিসিআইয়ের অনেক সাধারণ সদস্য চিৎকার করে সমর্থন দেন।

এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া নিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীর জোরালো বক্তব্যের পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটা ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বাচ্চারা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়; কীভাবে পরিবর্তন আনতে হয়। আমরা ব্যবসায়ীরা এক হওয়ার কথা বলছি। তবে আমরা এখনো একে অন্যের প্রতি ঘৃণা পুষে রেখেছি।...আমরা মিথ্যা কথা বলছি। যত দিন এগুলো থেকে বের হতে পারব না, তত দিন আমরা এক হতে পারব না।’

বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো হয়। সভাপতির পদে আসেন আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেল। তিনি বলেন, তালি আর তেল মারা কমাতে হবে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যবসায়ীদের নিগৃহীত হওয়ার কথা তুলে ধরে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি সবুর খান বলেন, ‘গত ১২ বছর যখনই ব্যবসায়ীরা সৎ কথা বলেছেন, তখনই তাঁদের হয়রানির জন্য করনথি (ট্যাক্স ফাইল) নিরীক্ষা করা হয়েছে। আমার করনথি পাঁচবার নিরীক্ষা করা হয়েছে। সুবিধাভোগী কর কর্মকর্তাদের করনথি নিরীক্ষা করা হোক। অর্থ নিয়ে অসামঞ্জস্য পাওয়া গেলে সরকারের কোষাগারে তা জমা দেওয়া হোক।’

ব্যবসায়ীরা দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি দাবি করেন। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা ব্যবসা চালাতে পারছি না। কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। বিদেশি ক্রেতারা আতঙ্কিত। তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি আমরা। ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।’