সৌদি ক্রীড়ায় বিপুল অর্থ ঢেলে মোহাম্মদ বিন সালমান কী চান
সৌদি প্রো লিগের ২০২৩-২৪ মৌসুম গতকাল শুরু হয়েছে। গত বছর এই ফুটবল লিগের খেলা তেমন একটা জমেনি। প্রতি ম্যাচে গড়ে ৯ হাজার ৩০০ দর্শক উপস্থিত ছিলেন। গত পাঁচটি মৌসুমের মধ্যে তিনটি মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন মরক্কোর খেলোয়াড় আবদের রাজাক হামদাল্লাহ। তিনি অবশ্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোনো ক্লাবে খেলেননি।
তবে এবারের মৌসুম ভিন্ন হতে পারে বলে দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে। হামদাল্লাহর দল আল ইত্তিহাদ ২০২২ সালের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী করিম বেনেজমাকে দলে ভিড়িয়েছে। বেনজেমা রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে সৌদি লিগে খেলতে এসেছেন। একই সঙ্গে ক্লাবটি দলে নিয়েছে চেলসির তারকা মিডফিল্ডার এন’গোলো কান্তেকে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আল নাসর ক্লাবে যোগ দিয়েছেন। লিভারপুলের সাবেক উইঙ্গার সাদিও মানেও আল নাসরে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন আল ইত্তিফাকে যোগ দিয়েছেন। তালিকা এখানেই শেষ নয়, আরও অনেক নামী খেলোয়াড় সৌদি আরবের লিগে খেলতে এসেছেন।
সৌদি লিগের ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বাবদ চলতি গ্রীষ্মে ৪৮ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এর ফলে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল লিগের কাতারে চলে গেছে সৌদি ফুটবল লিগ।
সৌদি আরব বৈশ্বিক ক্রীড়া আসরে নিজেদের জায়গা করে নিতে চায়। দেশটির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আছেন এ সবকিছুর পেছনে। এই যাত্রায় শুধু ফুটবল নয়, গলফ, ফর্মুলা ওয়ান মোটর রেসিং, বক্সিংসহ আরও বেশ কিছু খেলায় বিপুল বিনিয়োগ করছেন দেশটির বিনিয়োগকারীরা। বিন সালমানের লক্ষ্য, খেলাধুলার মাধ্যমে সৌদি আরবকে বিশ্বদরবারে নিয়ে যাওয়া; সেই সঙ্গে ৩ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার দেশটি সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বদলানো।
ডিজিটাল জগতের উত্থানের কারণে বিশ্বের ক্রীড়াশিল্প অন্য আরও অনেক খাতের মতো ধাক্কা খাচ্ছে। বেসরকারি ইকুইটি বিনিয়োগের জগতেও পরিবর্তন আসছে। তবে সমালোচকেরা বলেন, সৌদি যুবরাজ নিজ দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস মুছে ফেলে নতুন ভাবমূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করছেন, যাকে বলে ‘স্পোর্টস ওয়াশিং’।
সৌদি কর্মকর্তারা অবশ্য এসব সমালোচনা নাকচ করছেন। সৌদি আরবের ওয়াশিংটন দূতাবাসের কর্মকর্তা ফাহাদ নাজের দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, এই স্পোর্টস ওয়াশিংয়ের ধারণা সত্যি থেকে অনেক দূরে। শুধু তা–ই নয়, তাঁর দাবি, এ ধরনের কথার মধ্যে ‘জাতিকেন্দ্রিকতার’ গন্ধ আছে। এ সবকিছুর লক্ষ্য সৌদি আরব ও দেশের জনগণ।
অনেক পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, সৌদি আরবের এই বিনিয়োগের কারণে শুধু সৌদি আরব নয়, সারা বিশ্বের ক্রীড়া জগৎ বদলে যাবে। এর মধ্য দিয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমা মুরব্বিদের হাত থেকে বেরিয়ে আসবে; উদ্বোধন হবে নতুন গতিশীল ব্যবস্থার।
অর্থব্যয় অবশ্য নতুন কিছু নয়, কয়েক বছর ধরেই সৌদি লিগে বিনিয়োগকারীরা বিপুল অর্থ ঢালছেন। তবে এত দিন কিছুটা পরিকল্পনাহীন বিনিয়োগ হয়েছে। সৌদি ক্রীড়াশিল্পে স্তরে স্তরে বিনিয়োগ ও আলোচনা চলে। যেমন খেলোয়াড় কেনাবেচা, বিদেশি ক্লাব কেনা, অভ্যন্তরীণ ক্লাব বিকশিত করা ও দেশে-বিদেশে উঠতি টুর্নামেন্ট কেনা।
এসব চুক্তিতে সৌদি আরবের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে, যেমন সার্বভৌম সম্পদ তহবিল, বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি সৌদি আরামকো ইত্যাদি। এর সুযোগও নিতান্ত তুচ্ছ নয়; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খেলায় কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে।
ক্রীড়া ক্ষেত্রের এই উত্থান সৌদি আরবের সামগ্রিক উত্থানের একটি দিক মাত্র। নতুন এক উদার সমাজ নির্মাণে এবং পশ্চিমা জগতে হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে মোহাম্মদ বিন সালমান যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, ক্রীড়া তার একটি অংশ। তবে এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রীড়াজগতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে; নতুন ও বৃহৎ এক দর্শক শ্রেণিকে ধরা, নতুন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সৃষ্টি করা ও পুরোনো খেলা ফিরিয়ে আনা—এমন অনেক কিছুই এর মধ্য দিয়ে ঘটবে।
সৌদি আরবের সর্বশেষ পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (পিআইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে শুধু খেলাধুলায় বিনিয়োগের জন্য নতুন তহবিলের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ভবিষ্যতের জন্য বড় পরিকল্পনাও আছে। এবারের মৌসুমে নিঃসন্দেহ করিম বেনজেমা ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আলো কাড়বেন। তবে সৌদি আরবের আরও অনেক পরিকল্পনা আছে।