চামড়াপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার পথে এখনো বড় বাধা দূষণ

২১ বছরে চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব করতে পারেনি সরকার। এতে কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে অবস্থান শক্ত তৈরি হচ্ছে না। 

পুরোপুরি পরিশোধন ছাড়াই সাভারের ট্যানারির তরল বর্জ্য ফেলা হয় পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে। তাতে দূষিত হচ্ছে এ নদী। সম্প্রতি সাভার চামড়াশিল্প নগরীতেছবি: প্রথম আলো

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার পথে এখনো বড় বাধা দূষণ। সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য গড়ে তোলা যায়নি স্থায়ী ভাগাড় বা ডাম্পিং ইয়ার্ড। ফলে দূষণ থাকছেই, যা ট্যানারিগুলোর আন্তর্জাতিক মান সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এতে রপ্তানির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।

যদিও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চাচ্ছে সরকার। নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে গত সোমবার রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান করে সেখানে প্রবেশে কীভাবে সহায়তা করা যায়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে যেভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, প্রয়োজনে তিনটি পণ্যের ক্ষেত্রে তেমন সহায়তা দিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথাও হচ্ছে। পণ্য তিনটি হলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য।

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্পকে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শিল্পনগরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২১ বছরেও এই চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি।

চামড়া খাতের রপ্তানি বাড়াতে সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রণোদনা বাড়ানোসহ সম্ভাব্য সব সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা কোনো সমস্যা না। তবে সিইটিপির কার্যক্ষমতা উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। 

অবশ্য বিশ্ববাজার ধরার জন্য বাংলাদেশের চামড়া খাত এখনো প্রস্তুত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক মো. আবু ইউসুফ। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় উৎপাদকদের প্রণোদনা ও অন্যান্য সুবিধা দিলে হয়ত তাঁদের উৎসাহ বাড়বে। তবে পরিবেশ ও পণ্যের মানের ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা ছাড় দেবে না। এ জন্য সবার আগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। সেটি করা গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি স্বল্প সময়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারে নেওয়া সম্ভব হবে। 

সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক হলেই চামড়াশিল্প নগরের বেশ কয়েকটি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেয়ে যাবে। এতে দেশে উৎপাদিত চামড়ার বাজার বড় হবে। রপ্তানি তখন ধারাবাহিকভাবে বাড়বে। 
সাখাওয়াত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন

২১ বছরেও প্রস্তুত হয়নি 

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্পকে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শিল্পনগরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২১ বছরেও এই চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পাশের ধলেশ্বরী নদী দূষণের শিকার হচ্ছে। 

এই পরিস্থিতিতে দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে অবস্থান শক্ত করতে পারছে না চামড়া খাত। কারণ, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। দূষণের কারণে মূলত এ সনদের জন্য আবেদন করা যাচ্ছে না। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। 

চামড়া খাতের ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। মূল বাধা কোথায় সেটিও সবার জানা। ফলে দ্রুততম সময়ে বর্তমান সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর ও আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিতভাবে করতে ডাম্পিং ইয়ার্ড লাগবে। তারপর অন্যান্য বিষয়ে উন্নতি করে এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদন করতে হবে। 

সাভারের চামড়াশিল্প নগরে বর্তমানে ১৪২টি ট্যানারি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে গত নভেম্বরে এলডব্লিউজি স্বীকৃতি পেয়েছে সিমোনা ট্যানিং। প্রতিষ্ঠানটি ক্রাস্ট থেকে ফিনিশিং পর্যায়ে চামড়া উৎপাদন করে থাকে। তাদের নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি রয়েছে। তবে চামড়াশিল্পের বাকি সব ট্যানারি সিইটিপি ব্যবহার করে। ফলে তাদের কেউই এখনো এলডব্লিউজি স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে পারেনি।

সাভারের চামড়াশিল্প নগরের বাইরে দেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার ও এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ। এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ব্যবসা করছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। 

আরও পড়ুন

বৈশ্বিক বাজার বড়, হিস্যা কম 

কাঁচামাল না থাকার পরও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। গত অর্থবছর ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। অন্যদিকে দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকার পরও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মাত্র ১২২ কোটি ডলার, যা তৈরি পোশাকের চেয়ে সাড়ে ৩৮ গুণ কম। 

যদিও বৈশ্বিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর চামড়া পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইউরোপের বাজারই ১৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের। ২০৩০ সালে এই বাজার বেড়ে ৭৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। তবে বৈশ্বিক বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দশমিক ২৬ শতাংশ। 

ট্যানারি মালিকেরা বলছেন, ইউরোপসহ অনেক দেশে জুতাসহ বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া কারখানার চামড়া ব্যবহারের শর্ত রয়েছে। ট্যানারিগুলোর সেই সনদ না থাকায় প্রক্রিয়াজাত প্রতি বর্গফুট চামড়া গড়ে ৮৫–৯০ সেন্টে রপ্তানি করছে। সনদ থাকলে দ্বিগুণ দামে এসব চামড়া ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা যেত। সেটি না থাকায় বাংলাদেশের চামড়ার বড় ক্রেতা এখন চীন। 

আরও পড়ুন

শিল্পনগরের চিত্র

গত সোমবার হেমায়েতপুর চামড়াশিল্প নগরে সরেজমিন দেখা যায়, আগের মতোই অস্থায়ী ডাম্পিং ইয়ার্ডে কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সেটি উন্মুক্ত হওয়ায় আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে তরল বর্জ্য পরিশোধনের পর সিইটিপি থেকে পাইপের মাধ্যমে কালো পানি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। 

জানা যায়, সিইটিপির দৈনিক তরল বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। স্বাভাবিক সময়ে শিল্পনগরের ট্যানারিগুলোতে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার ঘনমিটার ও কোরবানির মৌসুমে ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। 

চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিইটিপির সার্বিক কার্যক্ষমতা ৫০ শতাংশের নিচে রয়েছে। 

এ বিষয়ে সিইটিপি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট বর্জ্য শোধনাগার কোম্পানির (ডিটিআইইডব্লিউটিপিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন মাসে সিইটিপির বেশ কিছু যন্ত্রপাতি সচল করা হয়েছে। বর্তমানে সিইটিপির কার্যক্ষমতা ৫০ শতাংশের ওপরে। আগামী চার মাসের মধ্যে এটিকে ৮০ শতাংশে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। 

ট্যানারি ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি চামড়া খাতের উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠক হয়। এতে উদ্যোক্তারা বন্ড লাইসেন্স ও নিরীক্ষার সময়ের মেয়াদ বৃদ্ধি, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাসহ কিছু কারখানাকে নিজস্ব ইটিপি নির্মাণে সহায়তা করার দাবি জানান। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে অন্য যেকোনো সুবিধার আগে চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানে নিতে হবে। এটা জটিল কোনো কাজ নয়। তিনি আরও বলেন, সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক হলেই চামড়াশিল্প নগরের বেশ কয়েকটি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেয়ে যাবে। এতে দেশে উৎপাদিত চামড়ার বাজার বড় হবে। রপ্তানি তখন ধারাবাহিকভাবে বাড়বে।