অর্থ আত্মসাতের দায়ে সোনালী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৮৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অন্য সদস্যদের মধ্যে আছেন তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, কন্যা ও জামাতা। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াত গত বৃহস্পতিবার এ মামলা করেন বলে জানান সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আখতারুল ইসলাম।

মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পাশাপাশি মামলার আসামিরা হলেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের স্ত্রী ও কোম্পানির পরিচালক ফজলুতুন নেসা, মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান, পুত্রবধূ শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ও আরেক মেয়ে তাসনিয়া কামরুন আনিকা। এ ছয়জনের বাইরে মামলার অন্য দুই আসামি হচ্ছেন কোম্পানির সদ্য বিদায়ী মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমান ও পদত্যাগকারী পরিচালক নূর-ই-হাফজা।

নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর আগে গত এপ্রিলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে। মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। তাঁর ছক অনুযায়ীই সোনালী লাইফের তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠলে গত ৩১ ডিসেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) হুদা ভাসিকে নিরীক্ষক নিয়োগ করে।

হুদা ভাসি গত এপ্রিলে প্রতিবেদন জমা দেয় আইডিআরএর কাছে। বিমাকারী ও বিমা গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে গত এপ্রিলেই প্রশাসক বসায় আইডিআরএ। কোম্পানিটি এখন প্রশাসকের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। এদিকে কোম্পানিটির ওপর পূর্ণাঙ্গ ও নিবিড় নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির কাজও চলমান।

মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস আজ শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে এ মামলা হয়ে থাকতে পারে। একটি পরিবারকে লক্ষ্য করে এসব করা হচ্ছে। এর আগে অবশ্য প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, শুরু থেকেই সোনালী লাইফ চলছে তাঁর ইম্পেরিয়াল ভবনে। যে টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, ভাড়ার টাকা সমন্বয় করলেও তা পূরণ হয়ে যাবে। কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও বড় কোনো অন্যায় তিনি করেননি বলে দাবি করেছিলেন।

মামলার আসামি ও কোম্পানির সাবেক সিইও রাশেদ বিন আমানের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজ যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পরিবারটির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

হুদা ভাসির প্রতিবেদন ও তার ভিত্তিতে কোম্পানিটিকে পাঠানো আইডিআরএর চিঠি বিশ্লেষণে জানা গেছে, পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে প্রতিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১ কোটি ৫ লাখ শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সোনালী লাইফ। বিএসইসি ২০১৮ সালের ১৪ জুন নগদ অর্থের বিনিময়ে এ শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেয়। আইডিআরএ বলেছে, কোম্পানিটির ২০ পরিচালকের মধ্যে ৭ জনই মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের। পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি অনিয়মের সুযোগ তৈরি করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের বড় মেয়ে কোম্পানির পরিচালক ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, বড় ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহানের স্ত্রী সাফিয়া সোবহান চৌধুরী, ছোট মেয়ে তাসনিয়া কামরুন আনিকার স্বামী শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল ও পরিচালক নূর এ হাফজার কাছ থেকে টাকা না নিয়েই ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার দেওয়া হয়। অন্যদিকে পরিচালক মায়া রাণী রায়, আহমেদ রাজীব সামদানী ও হুদা আলী সেলিমের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা অর্থাৎ প্রতি শেয়ারে ২০ টাকা হারে নেওয়া হয়।

মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ‘ইম্পেরিয়াল ভবন’ নামে একটি ভবন রয়েছে রাজধানীর মালিবাগে। ওই ভবনেই সোনালী লাইফের প্রধান কার্যালয়। ভবন কেনাবেচার জন্য এর মালিক ও সোনালী লাইফের মধ্যে দুটি সমঝোতা চুক্তি হয়। প্রথম চুক্তিটি হয় ২০২১ সালে, যাতে ভবনের দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২২ সালে সম্পাদিত দ্বিতীয় চুক্তিতে দাম বলা হয়েছে ১১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। উভয় চুক্তির একটির বিষয়েও পর্ষদের অনুমোদন ছিল না। অথচ জমি ও ভবন কেনা বাবদ অগ্রিম দেখিয়ে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে অবৈধভাবে ১৪১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সোয়েটার ক্রয়, আপ্যায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

ইম্পেরিয়াল ভবনের জমির মালিকানা ও ভবন নির্মাণের অনুমতি যাচাইয়ের জন্য মূল দলিল, বায়া দলিল, খতিয়ান, নামজারি, ভূমিকর পরিশোধের রসিদ নেই। ৭ কাঠা জমির ওপর ভবন নির্মাণের বরাদ্দপত্র, ইজারা চুক্তি ও ভবন নির্মাণের অনুমোদনও নেই। ফলে জমির মালিকানা নিষ্কণ্টক নয় ও ভবনের বৈধতাও প্রশ্নসাপেক্ষ বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়।

ইম্পেরিয়াল ভবনে ইম্পেরিয়াল ক্যাফে, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইম্পেরিয়াল স্যুট অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার, স্টার্লিং স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, রূপালী ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, ইম্পেরিয়াল হেলথ ক্লাব-এসব প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়া কারও কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়, এমন কোনো তথ্য পায়নি নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান।

আইনে কোম্পানির পর্ষদ বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য পরিচালকদের সম্মানী নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে, এক জামাতা, এক পুত্রবধূ ২ লাখ করে মাসে ১৪ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের বাইরে নূর-ই-হাফজাও মাসে ২ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এই আট পরিচালক এ পর্যন্ত বেতন বাবদ নিয়েছেন ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ কাজ তাঁরা করেছেন ১৪ মাস ধরে।

অবৈধভাবে বিলাসবহুল আউডি কার কিনতে কোম্পানির তহবিল থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ আইডিআরএর নির্দেশনা হলো, কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে।

এ ছাড়া পরিচালকেরা ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা অতিরিক্ত লভ্যাংশ ও ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা শিক্ষা ও ভ্রমণ ব্যয়ের জন্য নিয়েছেন। শেখ মোহাম্মদ ড্যানিয়েল গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে অবৈধ কমিশন নিয়েছেন। একসময় তিনি যখন পরিচালক ছিলেন না, তখন অবৈধভাবে ১১টি বৈঠকে অংশ নিয়ে সম্মানী নিয়েছেন। পরিচালক না হয়েও কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যৌথভাবে চেকে স্বাক্ষর করেন। যেসব চেকে ৩১ কোটি টাকা কোম্পানির তহবিল থেকে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে যায়। এ ছাড়া কোরবানির গরু কেনা, পলিসি নবায়ন উপহার, ঋণ সমন্বয়, অনুদান, এসি ক্রয় ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) খরচের নামে নেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

ড্রাগন আইটি, ড্রাগন সোয়েটার ও ড্রাগন স্পিনিং নামে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের আলাদা কোম্পানি আছে। ড্রাগন আইটিকে অফিসভাড়ার নামে দেওয়া হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। পুরো ইম্পেরিয়াল ভবনের ইউটিলিটি বিল সোনালী লাইফ থেকে পরিশোধ করা হয় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ড্রাগন সোয়েটার ও ড্রাগন স্পিনিংয়ের ১৪ লাখ টাকা করও দেওয়া হয় সোনালী লাইফের তহবিল থেকে।

আইডিআরএ বলেছে, বছরে গড়ে ২২ কোটি বা মাসে প্রায় ২ কোটি টাকা পেটি ক্যাশ হিসেবে ব্যয় হয়েছে এবং অনেক এককালীন বড় অঙ্কের লেনদেন নগদ চেকের মাধ্যমে হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অর্থ তছরুপের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ব্যাংক সিগনেটরি সবাই একই পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাঁদের স্বাক্ষরিত চেকের মাধ্যমেই বেশির ভাগ অবৈধ লেনদেন হয়।

ব্যক্তিগত ঋণ সমন্বয় বাবদ ২০১৬-১৮ সালে দুই বছরে ১১টি ভাউচারে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা নিয়েছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, যা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। চেয়ারম্যানের কোরবানির গরু ও এতিমখানার জন্য গরু কেনার টাকাও নেন তিনি সোনালী লাইফ থেকে। এ ছাড়া আইপিও খরচের নামে অতিরিক্ত ১ কোটি টাকা নেন তিনি।

সোনালী লাইফের পরিচালক (প্রশাসক নিয়োগের আগে) ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া আজ শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার চিঠি তাঁরা পাননি। আর নিরীক্ষা চলমান থাকার এ সময়ে হঠাৎ কেন মামলার সিদ্ধান্ত আসবে, তা তাঁর বোধগম্য নয়।