সরকারি চিনিকল
লোকসানের ‘হাতি’ পুষছে সরকার
সরকারি লোকসানি করপোরেশনগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। বেশি দামে চিনি উৎপাদন করে কম দামে তা বিক্রির ফলে বছর বছর বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। আবার বাজারেও এটি প্রভাব রাখতে পারছে না। সরকারি চিনিকলের হালচাল নিয়ে এক পাতার আয়োজন।
রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এই চিনিকলের আবার ১৫৮ কোটি টাকার ব্যাংকঋণও আছে। সেই ঋণের সুদ হিসাবে নিলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজিতে বিক্রি করতে পেরেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।
কেবল রংপুর নয়, বাকি ১৪টি সরকারি চিনিকলেই বর্তমান বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে উৎপাদিত হচ্ছে চিনি। তাতে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে করপোরেশন। তার মধ্যে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তা ছাড়া সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের দায় রয়েছে করপোরেশনের ঘাড়ে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
চিনি বিক্রি করে গত পাঁচ অর্থবছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন।
কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে চিনি উৎপাদন করেও বাজার কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না বিএসএফআইসি। প্রতিষ্ঠার সময় সরকারি চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে মাত্র ৮২ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করেছে মিলগুলো। দেশের বাজারে বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে করপোরেশন যে চিনি সরবরাহ করে, তা বাজার চাহিদার মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের সিটি গ্রুপ, দেশবন্ধু, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম ও আবদুল মোনেম গ্রুপ—এই পাঁচ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নিজস্ব কারখানার সম্মিলিতভাবে বার্ষিক চিনি পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে ৩৩ লাখ মেট্রিক টন।
এদিকে চিনি উৎপাদন করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়া বিএসএফআইসিকে নতুন করে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না সরকার। তাতে অর্থসংকটে পড়েছে করপোরেশন। সে কারণে চলতি মৌসুমে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসছে মৌসুমে আখ উৎপাদন কমে যেতে পারে। সেটি হলে লোকসানের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় কেবল চিনি বিক্রি করে চিনিকলগুলো লাভজনক করা সম্ভব নয়। ৬০ থেকে ৭০ বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে। পর্যাপ্ত আখও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবস্থাপনা ও বিপণনের দক্ষতায়ও রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, একসময় সরকারের চিনিকলের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। তবে বর্তমানে বাজারে তাদের হিস্যা অতি সামান্য। বেসরকারি রিফাইনারিগুলো বাজারের মোট চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি জোগান দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। বর্তমান বাস্তবতায় সব মিলিয়ে বাজারে তেমন কোনো প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে না সরকারি চিনিকল।
সিপিডির এই গবেষক বলেন, লোকসান কমাতে সরকারি চিনিকলগুলো তিন-চারটির মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। বাকিগুলো ধাপে ধাপে বন্ধ করে দিয়ে মিলের জমি বেজা ও বেপজার কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। তারা সেখানে অন্যান্য শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। তাতে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। পরে সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন দুটি একীভূত করে বিএসএফআইসি গঠিত হয়। বর্তমানে করপোরেশনের ১৫টি চিনিকল, ১টি ইঞ্জিনিয়ারিং, ১টি ডিস্টিলারি ও ১টি জৈবসার কারখানা আছে। করপোরেশনের অধীনে ১৯ হাজার ৮৯ একর জমি আছে। মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
আকাশছোঁয়া খরচ
বেশি দামে উৎপাদন করে কম দামে চিনি বিক্রির যে রেওয়াজ করপোরেশনে গড়ে উঠেছে, সেটিও তিন দশক আগের। ১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মাড়াই মৌসুমে রংপুর চিনিকলের প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের গড় খরচ ছিল সাড়ে ২২ টাকা। আর বিক্রি করা হয়েছিল ১৭ টাকা ২২ পয়সা কেজি দরে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত পাঁচ মাড়াই মৌসুমে রংপুর চিনিকলের প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গড় খরচ ৩১৯ টাকা ২৫ পয়সা। আর এক কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৪৯ টাকা ৯৫ পয়সায়।
রংপুরের মতোই পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ব্যাংকঋণের সুদসহ ৩০২ টাকা। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে ২৯৮, কুষ্টিয়ায় ২৭৩, জয়পুরহাটে ২৬৫, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯, কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে ২০৯, ফরিদপুরে ২০৩, মোবারকগঞ্জে ১৯৩, জিলবাংলায় ১৮০, পাবনায় ১৭৮, রাজশাহীতে ১৬৩, নাটোরে ১৫৯ এবং নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৩১ টাকা ৫৯ পয়সা। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ফরিদপুর চিনিকল গড়ে প্রতি কেজি ৫৭ টাকা ৫৪ পয়সায় বিক্রি করেছে।
সরকারি চিনিকলের মধ্যে তিনটি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে, তিনটি পঞ্চাশের দশকে, সাতটি ষাটের দশকে এবং দুটি স্বাধীনতার পর স্থাপিত হয়েছে। যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।
মুনাফায় কেবল কেরু
চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে চিনির পাশাপাশি আখের উপজাত দিয়ে জৈব সার, অ্যালকোহল, স্পিরিট, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। চিনি বিক্রি করে লোকসান করলেও উপজাত পণ্যের বদৌলতে গত অর্থবছরে ১৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে কেরু। তার আগের চার বছরও মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কেরু মুনাফা করলেও বাকি ১৪টি চিনিকল লোকসানের খপ্পরেই আছে। নাটোরের নর্থ বেঙ্গল চিনিকল গত অর্থবছর সর্বোচ্চ ৯৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। ৮০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে রাজশাহী, মোবারকগঞ্জ, নাটোর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল। বাকি ১০টি চিনিকল ৪৭ থেকে ৭৪ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছে।
লোকসান কমাতে কেরুর মতো সব কটি চিনিকলে স্পিরিট, অ্যালকোহল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনে গেলে কি সমাধান হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা বললেন, সে পথও বন্ধ। দেশের অভ্যন্তরে পণ্যগুলোর এত চাহিদা নেই।
কাজ কম, বেতন বেশি
হাজার কোটি টাকা লোকসান করলেও করপোরেশনের অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৬ হাজার ২৩৫। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৯ হাজার ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে কর্মকর্তা ৭১৪, কর্মচারী ৪ হাজার ৪০১ ও শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজার ৯০১ জন। এর বাইরে আখমাড়াই মৌসুমে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সব কর্মীর বেতন বাবদ মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ হয় করপোরেশনের।
আখের স্বল্পতার কারণে মিলভেদে বছরে আখমাড়াই কার্যক্রম ৪৭ থেকে ১২৬ দিন পর্যন্ত চলে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাবনা চিনিকলে ৪৭, জয়পুরহাটে ৪৯ দিন, শ্যামপুরে ৫৩, সেতাবগঞ্জে ৫৬ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৬১ দিন মাড়াইকাজ চলে। সর্বোচ্চ নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে ১২৬ ও জিলবাংলা চিনিকলে ১০১ দিন আখ মাড়াই হয়েছে।
জানা যায়, চিনিকলের কর্মীদের একটি অংশ আখ চাষ তদারক করলেও অনেকের হাতে বছরের একটা বড় সময় কোনো কাজ থাকে না। ফলে অনেককে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হয়। এ ছাড়া প্রায়ই প্রভাবশালীদের তদবিরে চিনিকলে নতুন নতুন নিয়োগ হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে স্থায়ী কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক ছিলেন ৪৬৩ জন। গত অর্থবছর সেটি বেড়ে ১ হাজার ১৪৯ জনে দাঁড়ায়। একইভাবে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের স্থায়ী কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ৪০৭ থেকে বেড়ে ৬৭৮ জন হয়েছে।
লাভে বেসরকারি মিল
বেশি দামে উৎপাদন আর কম দামে বিক্রি—এই তত্ত্বে চললেও উৎপাদিত সব চিনি বিক্রি করতে পারছে না করপোরেশন। যদিও সেনা, নৌ, পুলিশ, বিজিবির সদস্যদের রেশন হিসেবে সংস্থাটির চিনি বিক্রি হয়। তবে বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি এনে নিজেদের মিলে পরিশোধনের পর বিক্রি করে মুনাফা করছে।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৬ সালে সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের যাত্রা শুরুর পর তিন–চার বছরের মধ্যে আমরা মুনাফার দেখা পাই। বর্তমানে দিনে ৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন হয় কারখানায়।’